Home Featured ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির কাছে শত শ্রীরাম পরাস্ত

‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির কাছে শত শ্রীরাম পরাস্ত

‘মুসকানের কণ্ঠে আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি আর সাহস’

Mukto Chinta
০ comment ৩০২ views

সুপ্রিয়া দেবী , কলকাতা : কর্ণাটকের হিজাব পরিহীতা মুসকান এখন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এক প্রতিবাদী সাহসী কন্যার নাম। কি এক আধ্যাত্বিক শক্তি তাকে শত শত মানুষের সামনে নিজের মনের বিশ্বাসকে তুলে ধরার সাহস যুগিয়েছিলো সেটা ভেবে অনেকেই ক্লান্ত। গত ৮ জানুয়ারি ভারতের দক্ষিনাঞ্চলের রাজ্য কর্ণাটকের মান্দিয়া প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে এ্যাসাইমেন্ট জমা দিতে যান বিবি মুসকান খান। এ সময় তিনি হিজাব পরিহীত অবস্থায় স্কুটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আর থখনই উগ্রবাদীরা তার হিজাবের বিরোধীতা করে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগান দিতে দিতে তার দিকে এগিয়ে আসে। প্রতিবাদে মুসকান তার স্কুটি পার্ক করেই বীরের বেশে দাড়িয়ে হাত তুলে একাই শ্লোগান দিতে থাকে ‘ আল্লাহু আকবর। আল্লাহু আকবর। আল্লাহু আকবর।’ পিছু হটে যায় জয় শ্রীরাম শ্লোগান দেয়া শত শত যুবক। আর সেই ঘটনার ভিডিও ক্লিপ এক মুহুর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। মুসকানের প্রশংসা জানাতে বিশ্বাবাসী যেনো প্রস্তুতই ছিলো।
তবে হিজাবের বিরোধীতাকারীরা সারা দুনিয়ার সকল ধর্মের মানুষের সমালোচনার মুখে পড়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমর্থক বলে পরিচিত জয় শ্রীরাম শ্লোগানধারীরা। কিন্তু এই ঘটনার পর খোদ নরেন্দ্র মোদীও সমালোচনার মুখে পড়েছেন। সমালোচনার মুখে পড়েছে পুরো ভারতের শাসন ব্যবস্থা। বিশ্ববাসী প্রশ্ন তুলেছে তাহলে কি ভারতে মুসলীম ধর্মের অসুসারীরা নিরাপদ নয়। ভারতে মুসলমানদের উপর নির্যাতন নীপিড়নের ঘটনা নতুন নয়। গত কয়েক বছর যাবত বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদী সরকার গঠনের পর বহু মুসলমানকে নির্যাতন করে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এক মুসলীম নিধনের মধ্যেও মুসকানের এই প্রতিবাদী কণ্ঠসর সবাইকে সাহসী করে তুলেছে।


ভিডিওতে দেখা যায়, মুসকান একটি স্কুটি চালিয়ে কলেজে প্রবেশ করছেন। তাকে প্রবেশ করতে দেখে গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণ তাকে উদ্দেশ্য করে জয় শ্রীরাম শ্লোগান দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তাদের শ্লোগানের জবাবে মুসকান ‘আল্লাহু আকবার’ বলে শ্লোগান দেন। যদিও একজন শিক্ষকের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্তণে আসে তখনি। ওই শিক্ষক নিরাপদে মুসকানকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে কলেজ ভবনে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। তবে জয় শ্যরিাম শ্লোগান যারা দিচ্ছিলো তারা মুসকানের আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে ভেবাচেকা খেয়ে যায়। সবাই থমকে দাঁড়ায়।
পরে ওখান থেকে ফিরে মঙ্গলবার রাতে এনডিটিভিতে সরাসরি লাইভে যুক্ত হন তিনি। সেখানে উপস্থাপকের এক প্রশ্নের জবাবে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মুসকান বলেন, ‘ আমি ভীত ছিলাম না। আমি সেখানে গিয়েছিলাম অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে। কিন্তু তারা আমাকে ভেতরে যেতে দিচ্ছিল না। কারণ, আমি হিজাব পরে গিয়েছিলাম। কোনোভাবে একসময় আমি ভেতরে প্রবেশ করি। এ সময় তারা আমাকে উদ্দেশ্য করে জয় শ্রীরাম শ্লোগান দিচ্ছিল। তখন আমিও আল্লাহু আকবর ( আলআহ সর্বশক্তিমান ) বলে চিৎকার শুরু করি।’
যারা তাকে উদ্দেশ্য করে জয় শ্যীরাম শ্লোগান দিয়েছিল তারা কি ওই কলেজের ছাত্র ছিল কিনা জানতে চাইলে মুসকান বলেন, ‘তাদের মধ্যে কিছু ছিল কলেজের। অধিকাংশ ছিল বহিরাগত। তবে প্রিন্সিপালসহ অন্যান্য শিক্ষকরা আমাকে সাপোর্ট করেছেন। সে কারণে তারা বড় কোনো সমস্যা করতে পারেনি।’


মুসকান সব সময় বোরকা পরে কলেজে যান কিনা এমন প্রশ্নে বলেন, ‘হ্যাঁ , আমি সব সময়ই বোরকা এবং হিজাব পরে কলেজে যাই। শুধু তাই নয়, আমার শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই বোরকা ও হিজাব পরি। অতীতে এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি।’
যদি কলেজে আপনাকে বোরকা পরে ক্লাস করতে না দেয় তাহলে আপনি কি বোরকা ছেড়ে দিবেন নাকি আন্দোলন চালিয়ে যাবেন? মুসকান বলেন, ‘আমি আন্দোলন চালিয়ে যাবো। বোরকা তো একজন মুসলিম মেয়ের অংশ।’
লাইভ সাক্ষাৎকারে মুসকান আরও জানিয়েছেন তার কলেজের হিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকেও তিনি সাপোর্ট পেয়েছেন। তারা এটা নিয়ে তাকে কিছু বলেনি। কিন্তু বহিরাগতরাই তাকে দেখে জয় শ্রীরাম বলে শ্লোগান দিয়েছে এবং তার মতো বোরকা পরা আরও চার-পাঁচজনকে কলেজে ঢুকতে দেয়নি।
মুসকান এখন অনিরাপদবোধ করছে কিনা এমন প্রশ্নে বলেন, ‘না। সকাল থেকে পুলিশসহ অনেকেই এসেছেন। বলেছেন আমার পাশে তারা আছেন। সহযোগিতা করবেন।’
এদিকে, এনডিটিভি জানিয়েছে, সাহসের প্রতিক , কর্ণাটকের ভয়হীন মুসকান প্রতিটি মানুষের সাহসের উৎস হয়ে উঠেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অল ইন্ডিয়া মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমিনের (এআইএমআইএম) প্রেসিডেন্ট আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। মুসকানকে হয়রানির ভিডিও ভাইরাল ও এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনাম হওয়ার পর বুধবার তার সঙ্গে কথা বলেছেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। এরপর হায়দরাবাদ থেকে তিনি টুইটে লিখেছেন, ‘মুসকান ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছি। শিক্ষা গ্রহণের জন্য তার প্রতিশ্রæতি, কঠোর অবস্থানের জন্য আমি প্রার্থনা করি। পাশাপাশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ও তার পছন্দ বাছাই করার অধিকার চর্চার জন্য প্রশংসা করেছি। আমি এই বার্তাটিই দিয়েছি যে, তার ভীতিহীন অবস্থান আমাদের সবার কাছে সাহসের একটি উৎস হয়ে উঠেছে। তিনি বলেন, এক ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনির কাছে শত শ্রীরাম পরাস্থ হয়ে গেছে। মুসকানের কন্ঠে আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি আর সাহস। ’
মুসকানকে তার অবস্থানে স্থির থাকার জন্য তার পিতামাতার ভূমিকারও প্রশংসা করেছেন আসাদুদ্দিন ওয়াইসি। তিনি টুইটে লিখেছেন, তাকে অন্যায়ের কাছে মাথানত না করতে শিখিয়ে বড় করেছেন তার পিতামাতা।
এ জন্য তাদের প্রশংসা জানাই। ২০১৮ সালে কর্ণাটকে জেডি(এস)-এর পক্ষে বিধানসভা নির্বাচনের এক প্রচারণার অনুষ্ঠানে তার পিতার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিল আমার। এতে আমি সম্মানীত হয়েছি।’

ওদিকে এ ইস্যুতে বিক্ষোভ হয়েছে কলকাতাতে। বুধবার সেখানে বিপুল সংখ্যক মানুষ বিক্ষোভ করে শ্লোগান দিতে থাকেন। তারা হিজাব বন্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। এই বিতর্ক এখন আর ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বিভিন্ন দেশেও দেখা দিয়েছে বিক্ষোভ। ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই। পোশাক এবং শিক্ষার মধ্যে ব্যবধান করা নিয়ে সমালোচনা করেছেন তিনি। ভারতের নেতাদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন মুসলিম নারীদের একপেশে করে ফেলা বন্ধ করতে।
যুক্তরাষ্ট্র মুসকানের বিরুদ্ধে গেরুয়াবাদীদের এই ব্যবহারের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, প্রতিটি মানুষেরই তার ধর্মীয় আচার আচরণ পালন করার অধিকার রয়েছে।

এসব ঘটনা থেকে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছালেও কর্ণাটকে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার এখনো নীরব। তারা অপেক্ষা করছে কর্ণাটক হাইকোর্টের একটি সিদ্ধান্তের জন্য। কলেজে হিজাব পরা নিয়ে বিধিনিষেধ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত চেয়ে উদুপি’র একটি সরকারি কলেজের পাঁচ ছাত্রী আদালতে পিটিশন দায়ের করেছেন। সেই পিটিশনের জবাবে আদালত কী বলে সেদিকে তাকিয়ে আছে সরকার।

পিটিশনের জবাবে কোনো সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার ঘোষণা করেনি আদালত। তবে আদালত থেকে বলা হয়েছে, এই পিটিশনের আরও শুনানি হবে। এ সময়ে ছাত্রসমাজ ও জনগণকে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করেছে আদালত। জনগণের প্রজ্ঞা ও গুণাবলীর ওপর আদালতের পূর্ণ আস্থা রয়েছে বলেও জানায় তারা। আদালত আশা করে জনগণ সেই চর্চা অব্যাহত রাখবে।

প্রথমে উদুপি’র একটি কলেজে হিজাব ইস্যুতে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে হিজাব পরার দাবিতে বিক্ষোভ করতে থাকেন মুসলিম ছাত্রীরা। পরে তা কর্ণাটকের অনেক কলেজে ছড়িয়ে পড়ে। পাল্টা বিক্ষোভ করে বিজেপিপন্থি শিক্ষার্থীরা। তারা বিজেপির গেরুয়া শাল গলায় ঝুলিয়ে, পতাকা উড়িয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। এতে মুখোমুখি অবস্থান নেয় উভয় পক্ষ। মঙ্গলবার তাতে সাম্প্রদায়িকতার রঙ লাগে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে অধিক আগ্রাসীভাবে সংঘাতে লিপ্ত হয়।

এদিন উদুপি’তে একটি কলেজে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বিক্ষোভ করেন। এর একপক্ষ হিজাবের সমর্থক। অন্য পক্ষ গেরুয়া স্কার্ফ পরার পক্ষে। এখান থেকেই এদিন উত্তেজনার শুরু। এনডিটিভি বলছে, উদুপি’র গভর্নমেন্ট গার্লস পিইউ কলেজে গত মাসে শুরু হয় হিজাব বিষয়ক প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ওই সময় ৬ জন ছাত্রী অভিযোগ করেন, মাথায় স্কার্ফ পরে ক্লাস করায় তাদেরকে বাধা দেয়া হয়েছে। ক্লাসরুমে মুসলিম বালিকাদের হিজাব পরার বিরোধিতা করে উদুপি এবং চিক্কামাগালুরুর উগ্র ডানপন্থিরা।

শুরুটা এখান থেকে হলেও বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে উদুপি এবং অন্যান্য স্থানে। এ অবস্থায় রাজ্য সরকার শনিবার এমন পোশাক নিষিদ্ধ করে, যা সমতার ক্ষেত্রে, সম্মানের ক্ষেত্রে এবং জনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে বিঘœ সৃষ্টি করে। তবে প্রশাসনিক কমিটি ওই কলেজের জন্য কোনো নির্দিষ্ট পোশাক কোড নির্বাচন করেনি।
চলমান এসব বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে মুসকান জানান, ‘এই আন্দোলন শুরু হয়েছে গত সপ্তাহে। আমরা সব সময় বোরকা ও হিজাব পরি। ক্লাসে আমি বোরকা খুলে রাখি। তবে ক্লাসেও হিজাব পরে থাকি। কারণ হিজাব হলো আমার পবিত্রতার অংশ। এ নিয়ে প্রিন্সিপাল আমাদেরকে কিছুই বলেননি কখনো। আমাদের হিজাব নিয়ে বিরোধিতা শুরু করেছে বহিরাগতরা। তাই আমাদেরকে বোরকা না নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন প্রিন্সিপাল। আমরা হিজাবের দাবিতে অব্যাহতভাবে বিক্ষোভ করছি। একজন মুসলিম মেয়ের জন্য হিজাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’
উল্লেখ্য, মুসকান ওই কলেজের দ্বিতীয় বর্ষ কমার্সের ছাত্রী। তাকে এখন সমর্থন করছেন হিন্দু বন্ধুবান্ধবীরাও। মুসকান বলেন, সকল মহলের ও সব ধর্মের বন্ধুদের সমর্থনের কারণে আমি নিরাপদ বোধ করছি। আমাকে সবাই বলেছেন, ‘আমরা আছি তোমাদেরসাথে।’ মুসকানের বন্ধু এবং আত্মী-স্বজনরা মনে করেন, ‘মুসকান হচ্ছে অধিকার রক্ষা এবং নিজ ধর্ম পালনে বদ্ধপরিকর একজন সাহসী নারী। বর্তমান সমাজে তার মতো একজন নারী সবার জন্য অহংকার।

 

 

You may also like

Leave a Comment

Muktochinta

Multochinta is a famous news media from New York. 

Subscribe my Newsletter for new blog posts, tips & new photos. Let's stay updated!

All Right Reserved. 2022 emuktochinta.com