Home Featured রহস্যঘেরা সাংবাদিক খুনের ঘটনা

রহস্যঘেরা সাংবাদিক খুনের ঘটনা

সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না

Mukto Chinta
০ comment ৪৫০ views

পলাশ সরকার, ঢাকা : এ এক রহস্যঘেরা খুনের ঘটনা। সবাই চিনে খুনীকে। কারা খুন করিয়েছে? কিন্তু কারো বলার ক্ষমতা নেই। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ , যে দেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার, হুমকি , মারধর খুব নিত্য নৈমত্তিক ঘটনা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক সাংবাদিক প্রভাবশালীদের হাতে নিহত হলেও সেগুলোর বিচার চাপা পড়ে যায়। কিন্তু সাগর-রুনি অত্যন্ত পরিচিত সাংবাদিক দম্পত্তি হওয়ার কারণে সেটা চাপা দেওয়া সম্ভব না হলেও বিচারের বাণী এক দশক ধরে নিরবেই কাঁদছে। তদন্তকারীরা এই খুনের রহস্যের কোনো কুলকিনারাই খুঁজে পাচ্ছে না।


মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলা টিভি’র সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসার তিন তলার ফ্লাটে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। আতাতায়ীরা জানালার গ্রিল কেটে সেখানে ঢুকেছিলো বলে প্রথমে বলা হলেও পরে আর এ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা আর কোনো কথাই বলতে রাজী হননি। ঘটনার দিন তারা দুজনেই সারাদিন কাজ করে বাসায় ফিরেন। প্রথমে রুনি তার সাড়ে চার বছরের সন্তান মেঘকে নিয়ে বাসায় যান। সে রাতে সাগরের ছিলো নাইট ডিউটি। তার বাসায় ফেরার কথা ছিলো পরদিন সকালে। অবসরপ্রাপ্ত একজন সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তার ধারণা অফিসে কর্মরত অবস্থায় সাগর সম্ভবত রুনীর ফোন কল পেয়ে তড়িঘরি মন খারাপ করে অফিস থেকে বাসায় রওয়ানা হন। সাগর জানতো না তাদের জন্য কি বিপদ অপেক্ষা করছে। সম্ভবত রুনিকে বাসায় জিম্মি করে সাগরকে ফোন করা হয়। আর সে কারণেই হয়তো সাগর কাউকে কিছু বলেননি। অথবা সন্তানের সামনে সন্তানকে জিম্মি করে খুনীরা সাগরকে ফোন করতে বাধ্য করে। কাউকে কিছু জানালে তাদের আগে হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়েছিলো হয়তো। আর সে কারণেই সাগর কাউকে জানায়নি। কিন্তু সে বাসায় যাবার পর তাদের সাড়ে চার বছরের একমাত্র সন্তান মেঘের সামনেই কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দুজনকে। দুজনকে হত্যার পর তাদের বাসার কোনো মূল্যবান সম্পদ, অর্থ, সোনা বা দামি কিছুই খুনীরা নেয়নি। তাদের টার্গেট ছিলো সাগর-রুনির ল্যাপটপ আর মোবাইল ফোন। যেগুলোতে জ্বালানী খাতের দূর্নীতির খবর আর ছবি ছিলো বলে ধারনা করা হয়। ওই কর্মকর্তার মতে, ‘খুনীরা চাইলে তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটম এবং ফোন নিয়ে চলে যেতে পারতো সহজেই। কিন্তু তারা আর রিস্ক নিতে চায়নি। অর্থাৎ কোনো প্রমান অবশিষ্ট রাখতে চায়নি বলেই সাগর-রুনিকে শেষ করে দিয়ে প্রমান হাতে নিয়ে চলে যায়।’


এত বড় ঘটনা ঘটলেও ঘটনার রাতে পাশের ফ্লাটের কেউ চিৎকার বা চেঁচামেচি শুনেছিলো কিনা সে বিষয়েও কিছুই বলছে না তদন্তকারিরা। যারা সে সময় তাদের পাশের ফ্লাটে ছিলো তারাও এখন কোথায় আছে সেটাও জানা যাচ্ছে না।
হত্যাকান্ডের পরদিন সকালে এই খুনের বিষয়ে রুনির ভাই নওশেদ আলম শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা দায়ের করেন। প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন পুরো দেশের সাংবাদিক সমাজ। চাপে পড়ে সে সময়কার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের গ্রেফতারের ঘোষণা দেন। কিন্তু এরপর ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ, মাস, বছর কেটে যায় । খুনী গ্রেফতারতো দুরের কথা উল্টো রুনির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে সরকারের একটি মহল। সাহারা খাতুনের পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মহিউদ্দীন আলমগীর। মহিউদ্দিন আলমগীর রুনির চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুললে সাংবাদিকরা এর প্রতিবাদ করেন। প্রকৃতপক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে এটা প্রমানের চেষ্টা করা হচ্ছিলো যে, ‘রুনির চরিত্র খারাপ হবার কারণেই কোনো ঝামেলায় তারা খুন হয়েছে।’
নিহত সাগর-রুনির পরিবারের ঘনিষ্ট একজন জানিয়েছেন, ‘সবাই জানে খুনী কে আর কারা খুন করিয়েছে ? কিন্তু সেটা জানার পরেও কেউ কিছু বলছে না। কারণ খুনীরা সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী। ’ একই ধরনের কথা বলেছেন, একাধিক সাংবাদিক নেতা। তারা নিজেদের নাম প্রকাশ করেেত চান না, মামলার ভয়ে, ডিজিটাল আইনের ভয়ে। এমনকি সরাসরি কথা বললে তাদের গুম করা হতে পারে বলেও আশংকা করেন তারা। আর তাই নাম প্রকাশ না করে, বলেন, ‘এটা জাতিসংঘও বলেছে এই হত্যার পেছনে কারা জড়িত। অথচ সরকার এদিকে নজর দিচ্ছে না। কারণ সরকারের কাছে হত্যাকারীর বিচারের চেয়ে ব্যক্তিগত সম্পর্ক রক্ষা করা বেশি জরুরী।
সাংবাদিরা নানাভাবে চাপ দিতে থাকলে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়ে দেন , ‘ কারো জীবনের নিরাপত্তার জন্য বেডরুম পাহাড়া দেয়া সম্ভব না।’ প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তি নিয়ে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। ধীরে ধীরে প্রমাণ হতে থাকে সম্ভাব্য হত্যাকারীদের সংশ্লিষ্টতা। অভিযোগ উঠে জ্বালানী খাতের একটি বড় দূর্নূীতির খবর প্রকাশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সাগর এবং রুনি। কিন্তু জ্বালানী খাতের ওই ব্যবসায়ী সরকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ট। তাদের দুই পরিবারের মধ্যে রয়েছে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের একজনের ছেলের সাথে ওই ব্যবসায়ীর তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের কথাও প্রচার হয়। আর সে কারণেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো পদক্ষেপ নিতে বারবার বাধাগ্রস্থ হয়। এক পর্যায়ে ক্ষমতার দাপট বুঝতে পেরে কেবল সময়েক্ষপন করতে থাকে। ঘটনা গড়ায় আদালত পর্যন্ত। আদালত বারবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বললেও সে দিকে কোনো কর্ণপাত করে না তদন্ত কর্মকর্তারা। ১০ বছরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৮৫ বার সময় নেয়া হয়েছে। ৬ জন তদন্ত কর্মকর্তা বদল হয়েছে। পুলিশ, ডিবি, সিআইডি’র হাত ঘুরে তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছে র‌্যাব। র‌্যাব দায়িত্ব পাবার পরও ৯ বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু তারাও কোনো প্রতিবেদন আদালতে জমা দিচ্ছে না।
বারবার বলা হচ্ছে নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ডিএনএ পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল অনেক আগেই বাংলাদেশে পাঠানো হলেও এখন তদন্ত কর্মকর্তারা নানা টালবাহানা করছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেয়ার জন্য।
একাধিক সাংবাদিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, এই খুনের সাথে একটি প্রভাবশালী মহল জড়িত। আর সে কারণেই কারো ক্ষমতা নেই এ বিষয়ে সঠিক তদন্ত প্রকাশ করার। তারা অভিযোগ করে বলেন, সাগর রুনির হত্যার খুনীদের বিচার না চাইবার পুরস্কার হিসেবে একাধিক সাংবাদিক নেতা সরকারের উচ্চপদে চাকুরী করার সুযোগ পেয়েছেন। তারা সুবিধা নিয়ে সাগর-রুনির রক্তের সাথে বেঈমানী করেছেন। রাষ্টীয় পুরস্কার পাবার পর ওইসব সাংবাদিক নেতারা সাগর-রুনির বিচার নিয়ে আর মুখ খুলেননি।
সাগর-রুনির হত্যার বিচারের অপেক্ষায় থেকে রুনির বৃদ্ধা মা পরপারে চলে গেছেন। সাড়ে চার বছরের শিশু সাগর-রুনির ছেলে ‘মেঘ’ এখন ১৫ বছরের তরুন। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন সবাই বিচারের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তাদের প্রশ্ন ‘আসলেই কি সরকার খুনীদের ধরার জন্য প্রস্তুত ? তারা মনে করছে এই সরকার খুনীদের ধরবে না। তাদের নামও প্রকাশ করবে না। কারণ সরকারের সাখে খুনীদের রয়েছে ব্যবসায়িক যোগাযোগ।’
আগামী ২৩ ফেব্রæয়ারি আবারও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য আদালত সময় দিয়েছে। কিন্তু এটা এখন সবাই বুঝতে পারছে যে, আদালতও একটি গেইমের মধ্যে পড়ে গেছে। তারাও সরকারের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছে। ফলে ৮৫ বার সময় নেয়ার পরও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করার জন্য কারো বিরুদ্ধেই কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি আদালত।
এদিকে ১০ বছর পার হয়ে যাবার পরও এই খুনের কোনো বিচার বা খুনীদের সম্পর্কে তত্য প্রকাশ না করার জন্য সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে খোদ জাতিসংঘ। ১০ ফ্রেবুয়ারি সাগর-রুনি খুনের দশ বছর পূর্তিতে জাতিসংঘ তাদের দেয়া এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘জ্বালানী খাতের একটি বড় কোম্পানী এই খুনের সাথে জড়িত। বাংলাদেশে সাংবাদিক নির্যাতনের কোনো বিচার হয় না। আর সে জন্যই বারবার একি ধরনের ঘঠনা বাংলাদেশে ঘটছে। তারা দ্রæত সাগর-রুনি হত্যার আসামীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছে।”

You may also like

Leave a Comment

Muktochinta

Multochinta is a famous news media from New York. 

Subscribe my Newsletter for new blog posts, tips & new photos. Let's stay updated!

All Right Reserved. 2022 emuktochinta.com