নাজমুল আশরাফ
দলীয় বিভক্তির কারণে বাইডেন প্রশাসনের কোনো ব্যর্থতার সুযোগই নিতে পারছে না রিপাবলিকানরা। মুলত ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলায় ডনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকা এবং এ দুটি বিষয়ে ট্রাম্পের ভিত্তিহীন অভিযোগই রিপাবলিকান পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দিচ্ছে না। কোনো রকম তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ এখনো করে যাচ্ছেন ট্রাম্প ও তাঁর অনুসারীরা। ক্যাপিটলে হামলায় ট্রাম্প ও ট্রাম্প-ঘনিষ্ঠ রিপাবলিকানদের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ হাউয সিলেক্ট কমিটির তদন্তে একের পর এক বেরিয়ে আসার পরও ট্রাম্পপন্থীরা ৬ই জানুয়ারীর বিদ্রোহকে বৈধ রাজনৈতিক কর্মকান্ড বলে দাবি করছেন। এ নিয়ে দলের বিভক্তি দিন দিন বাড়ছে। অথচ প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের বড় বড় ব্যর্থতাকে কাজে লাগাতে পারছেন না রিপাবলিকান পার্টি। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ২০২০ নির্বাচন ও কংগ্রেসে হামলা নিয়ে মিথ্যাচার এবং ট্রাম্পের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটি।
৬ই জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলার পর ডেমোক্র্যাটরা যতো বেশি সোচ্চার হন, রিপাবলিকানরা ততো বেশি চুপচাপ হয়ে পড়েন। কিন্তু এ বিষয়ে রিপাবলিকান পার্টিতে বিভক্তি কতোটা গভীর ছিল, সেটাই এখন প্রতিনিয়ত বেরিয়ে আসছে। ক্যাপিটলে হামলার প্রথম বর্ষপূর্তিতে, সেই ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সম্মানে হাউযে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কয়েক ডযন ডেমোক্র্যাটের সাথে যোগ দেন একমাত্র রিপাবলিকান হাউয সদস্য লিয চেইনি। তাঁর বাবা সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেইনি লিযের সাথে ছিলেন। হামলার দিন নিজেদের অভিজ্ঞতা নিয়ে সেনেট ফ্লোরে কথা বলেন এক ডযনেরও বেশি ডেমোক্র্যাট। তবে কোনো রিপাবলিকান সেনেটরই কথা বলেন নাই। কেউ কেউ লিখিত বিবৃতি দেন। সেনেট রিপাবলিকান নেতা মিচ ম্যাককনেলসহ তাদের বেশিরভাগই জর্জিয়ায় চলে যান তাদের এক সাবেক সহকর্মীর অন্তোষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। ৬ই জানুয়ারি ওয়াশিংটনে রিপাবলিকানদের গণ অনুপস্থিতি দেশের মানুষকে এই বার্তাই দেয় যে, ক্যাপিটলে হামলা নিয়ে গোটা জাতি বিভক্ত। হামলার বিবরণ, এর জন্য কারা দায়ী এবং এ বিষয়ে কি করা উচিত এসব বিষয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। এই পার্থক্য শুধু দুই দলের মধ্যেই না, রিপাবলিকান পার্টিতেও বিস্তর।
লিয চেইনির মতো কিছু রিপাবলিকান বিশ্বাস করেন, কংগ্রেসের দুই চেম্বারের যৌথ অধিবেশনে যখন ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় সত্যায়নের সাংবাধানিক প্রক্রিয়া চলছিল, তখন সেখানে হামলা করার জন্য দাঙ্গাকারীদের উস্কে দেন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। বাকি রিপাবলিকানরা ৬ জানুয়ারির ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন এবং দলীয় স্বার্থে ভয়ের সংস্কৃতি ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ডেমোক্র্যাটদের অভিযুক্ত করেন। কিন্তু বেশিরভাগ রিপাবলিকানই মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন। তারা ৬ জানুয়ারি বা ট্রাম্পকে নিয়ে কথা বলতে চান না, এমনকি যারা হামলার পরপরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ট্রাম্পের সমালোচনায় সরব ছিলেন, তারাও। সার্বিকভাবে রিপাবলিকান পার্টির অবস্থান, ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ছাড়াও, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, তদন্তকারী ও বিশ্লেষকদের চেয়েও সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়।
সম্প্রতি, ক্যাপিটলে হামলাকে ‘কংগ্রেসের জন্য একটা ‘অন্ধকার দিন’ উল্লেখ করে হামলাকারীদের বিচার প্রক্রিয়ায় সমর্থন জানান মিচ ম্যাককনেল। প্রায় এক বছর আগে, উশৃংখল জনতাকে দাঙ্গায় উস্কানী দেয়ার অভিযোগে সেনেটে ট্রাম্পের অভিশংসন প্রক্রিয়া চলার সময় সাবেক এই প্রেসিডেন্টকে দায়ী করলেও, এবার তিনি তাঁর নাম উল্লেখ করেন নাই। বরং ৬ জানুয়ারির বর্ষপূর্তিকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারের জন্য ডেমোক্র্যাটদের অভিযুক্ত করেন। ক্যাপিটলে দাঙ্গার জন্য ট্রাম্পকে অভিযুক্ত করার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ১০ জন হাউয রিপাবলিকান এবং তাঁকে অভিশংসনের পক্ষে ভোট দেন ৭ জন সেনেট রিপাবলিকান। যদিও দ্বিতীয় অভিশংসনেও ট্রাম্প খালাস পান।
লিয চেইনি শুরু থেকেই ২০২০ নির্বাচনে জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে আসছেন। কংগ্রেসে হামলার চার মাস পর, হাউয রিপাবলিকান কনফারেন্স চেয়ারের পদ থেকে লিয চেইনিকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপরপরই তাঁকে হাউয সিলেক্ট কমিটির সদস্য নির্বাচন করেন স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। চেইনি ছাড়া এই কমিটির আরেক রিপাবলিকান সদস্য অ্যাডাম কিনজিঙ্গার। এই কমিটিই ৬ জানুয়ারি হামলার তদন্ত করছে। হামলার বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে কিনজিঙ্গারও থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর স্ত্রী সন্তানসম্ভবা হওয়ায় সেটা করতে পারেন নাই। দেশের গণতন্ত্র বিপদে আছে উল্লেখ করে বর্ষপূর্তিতে লিয চেইনি বলেন, এমন কিছু মুহুর্ত আছে, যখন সংবিধান রক্ষায় সবাইকে এক হতে হয়। রিপাবলিকান পার্টির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, যে দল একটি গোত্রীয় ব্যক্তিত্বের দাস, সে দল দেশের জন্য বিপদজনক। তবে ট্রাম্পের অভিশংসনের পক্ষের অন্য রিপাবলিকানরা সাবেক প্রেসিডেন্টের ব্যাপারে নরম সুরে বা ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলছেন। তাদের বেশিরভাগই ট্রাম্পের নাম নিচ্ছেন না বা তাঁর সাথে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করছেন না। শীর্ষ রিপাবলিকানদের মতো তাঁরাও ক্যাপিটলে হামলার জন্য নিরাপত্তা ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন। ট্রাম্প-বিরোধী অন্যতম রিপাবলিকান সেনেটর মিট রমনি বলেছেন, নিজেদের বিপদের কারণে তাঁরা ৬ জানুয়ারির ঘটনা থেকে কোনো শিক্ষা নিচ্ছেন না। তিনি বলেন, দেশের গণতন্ত্র এখন ভঙ্গুর। আগামি নির্বাচনে জেতার চেয়ে প্রজাতন্ত্রের শক্তিকে বেশি গুরুত্ব দেবেন, তেমন সৎ ও চরিত্রবান নেতৃত্ব ছাড়া গণতন্ত্র টিকতে পারে না। রমনি আবারো বলেছেন, হতাশ ভোটারদের প্রতি সম্মান দেখানোর সেরা উপায় হচ্ছে, তাদেরকে সত্যটা জানানো।
হামলার বর্ষপূর্তিতে আলাদা অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন, ট্রাম্পের সবচেয়ে শক্তিশালী দুই সমর্থক –জর্জিয়ার কংগ্রেসওম্যান মারজোরি টেইলর গ্রীন এবং ফ্লোরিডার কংগ্রেসম্যান ম্যাট গেইটয্। তারা মুলত ক্যাপিটলে হামলায় ফেডারেল কর্তৃপক্ষ, বিশেষ করে এফবিআই’র জড়িত থাকার অভিযোগের পূণরাবৃত্তি করলেও, নতুন কোনো তথ্য দিতে পারেন নাই। রিপাবলিকানরা প্রায় একযোগে ৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটির বিরোধীতা করলেও, গেইটয্ বলেছেন, মধ্যবর্তী নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠাতা ফিরে পেলে, হামলায় ফেডারেলের জড়িত থাকার সম্ভাব্যতা যাচাই করতে এই কমিটিকে দায়িত্ব দেয়ার সুপারিশ করবেন তিনি। অন্যদিকে গ্রীন অভিযোগ করেন, গত এক বছর রিপাবলিকান কণ্ঠ, রিপাবলিকান ভোটার এবং ট্রাম্প সমর্থকদের টানা কলংকিত করা হয়েছে। সেজন্য রিপাবলিকানদের কথা শোনা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ৬ জানুয়ারির বর্ষপূতিতে ট্রাম্প সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিয়ে পিছিয়ে এলেও, ট্রাম্পের পক্ষে সেই কাজটি করেছেন গেইটয্ ও গ্রীন।
বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দেয়া ভাষণে, ট্রাম্প ও দাঙ্গার কঠোর নিন্দা জানান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, তাঁর পূর্বসূরী ২০২০ নির্বাচন সম্পর্কে টানা মিথ্যাচার করেছেন। সংবাদ সম্মেলন বাতিল করলেও বাইডেন ও তাঁর ভাষণ এবং ৬ জানুয়ারি তদন্ত কমিটি নিয়ে একের পর এক বিবৃতি দেন ডনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেন, বাইডেন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। সেই ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি সরাতেই এই রাজনৈতিক নাটক সাজানো হয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির যে অংশটি নির্বাচনে জালিয়াতির ট্রাম্পের ভিত্তিহীন অভিযোগ জোরদার করেছেন, তাদের সমালোচনা করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেছেন, প্রাথমিকভাবে অনেক রিপাবলিকানই প্রত্যাখ্যান করলেও, পরে সেই অভিযোগ জোরদার করেন ভোটার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ। এটাই ৬ জানুয়ারির সন্ত্রাসে ইন্ধন জোগায়। বাকি রিপাবলিকান নেতাদের মধ্যে যারা সাহস করে গণতন্ত্রবিরোধী প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়ান, তাঁদেরকে অপমান ও দলে কোনঠাসা করা হয় এবং কাউকে কাউকে দল ছাড়তে বাধ্য করা হয়। দেশে-বিদেশে নানা সংকটে প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন হিমশিম খাচ্ছেন, তখন রিপাবলিকানরা ভাবলেন, হাউয ও সেনেটের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার সুযোগ এসেছে। সেই সুযোগ কাজে লাগাতে দলের ঐক্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করলেন তারা। ঠিক তখনি ৬ জানুয়ারির ক্ষত আবারো জাগিয়ে তুলেছে রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটি, আরএনসি। ক্যাপিটলে হামলার তদন্তে হাউয সিলেক্ট কমিটিতে ডেমোক্র্যাটদের সাথে কাজ করার জন্য অ্যাডাম কিনযিঙ্গার ও লিয চেইনিকে আনুষ্ঠানিকভাবে তিরস্কার করে আরএনসি। এমনকি ওই হামলাকে বৈধ রাজনৈতিক কর্মকান্ড বলেও উল্লেখ করা হয়েছে আরএনসি’র প্রস্তাবে। এতে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েন ঐক্যের চেষ্টায় থাকা রিপাবলিকান আইনপ্রনেতারা। ট্রাম্পের উস্কানিতে ভয়াবহ হামলাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টার জন্য আরএনসি চেয়ারওম্যান রনা ম্যাকড্যানিয়েলকে পুরোপুরি দায়ী করেন রিপাবলিকানদের কেউ কেউ। এ বিষয়ে টেক্সাসের সেনেটর জন কর্নিন সিএনএন’কে বলেছেন, রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে রিপাবলিকানদের আঘাত করা থামানো উচিত। ম্যাকড্যানিয়েলের পদত্যাগ করা উচিত কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে সেনেট রিপাবলিকান হুইপ জন থুন বলেছেন, এটা আসলে আরএনসি’র ওপর নির্ভর করবে। তবে এই কাজটা মোটেও গঠনমুলক হয় নাই। নির্বাচনে জেতার জন্য ডেমোক্র্যাট, রিপাবলিকান সবার বিরুদ্ধেই কাজ করলে কোনো লাভ হবে না। ঐক্যের চেষ্টা করা রিপাবলিকানরা ব্যক্তিগতভাবে ম্যাকড্যানিয়েলের চাচা, রিপাবলিকান সেনেটর মিট রমনির সাথে যোগাযোগ করছেন বলে জানিয়েছে সিএনএন। আরএনসি’র কাজটা যে দলের জন্য কতোটা ক্ষতিকর হয়েছে, ম্যাকড্যানিয়েলকে সেটা বুঝিয়েছেন রমনি। এছাড়া আরএনসির প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন প্রায় দেড়শো জন বর্তমান ও সাবেক রিপাবলিকান। ৬ জানুয়ারি নিয়ে আর কথা না বলে অর্থনীতি, অপরাধ এবং মহামারিতে স্কুল বন্ধ রাখার বিষয়ে মধ্যবর্তী নির্বাচনকে বাইডেনের ওপর গণভোট হিসাবে দাঁড় করাতে চান রিপাবলিকানরা। কিন্তু ট্রাম্প এখনো নির্বাচনে পরাজয়ের গøানি থেকে বের না হওয়ায় এবং দলের মধ্যে কল্পিত শত্রুদের সাজা দিতে বদ্ধপরিকর থাকায়, তাদেরকে ২০২০ নির্বাচন নিয়ে সাবেক এই প্রেসিডেন্টের ষড়যন্ত্র তত্তে¡র মধ্যেই আটকে থাকতে হচ্ছে। বিশেষ করে বাইডেনের জনসমর্থনে ধ্বস এবং নিজেদের সমর্থন বাড়তে থাকার মতো সময়েও এমন চর্চা রিপাবলিকানদের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। #