বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার করে সুইস ব্যাংকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে গোল্ডেন ভিসায় দুবাইয়ে সম্পদ গড়েছেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। যেখানে বাংলাদেশিদের মালিকানায় ৯৭২টি সম্পদ কেনার তথ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের এমন তথ্য-উপাত্ত জানতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আলাদা চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের মানিলন্ডারিং উইংয়ের পরিচালক শাখা থেকে ওই চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে।
চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করে রোববার (১৬ এপ্রিল) দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বিএফআইইউয়ের পরিচালকের কাছে পাঠানো চিঠিতে ওই ৫৪৯ জন বাংলাদেশির অর্থপাচারের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে কিংবা সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কমিশনের পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। অন্যদিকে এখন পর্যন্ত ঠিক কতজন বাংলাদেশি গোল্ডেন ভিসা ও আবাসিক ভিসা নিয়েছে, তাদের তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে চেয়েছে দুদক।
এর আগে গত ১০ এপ্রিল এ সংক্রান্ত অভিযোগ অনুসন্ধানে তিন সদস্যের একটি টিম গঠন করে দুদক। গত ১৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট থেকে দুবাইয়ে অবস্থানরত ৪৫৯ বাংলাদেশি নাগরিকের সম্পদ কেনার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগের বিষয়ে দুদকসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশ্যে-গোপনে বিপুল পরিমাণ মূলধন স্থানান্তরিত হচ্ছে দুবাইয়ে। এ অর্থ পুনর্বিনিয়োগে ফুলে ফেঁপে উঠছে দুবাইয়ের আর্থিক, ভূ-সম্পত্তি ও আবাসনসহ (রিয়েল এস্টেট) বিভিন্ন খাত। ২০২০ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বাংলাদেশিদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য রয়েছে। কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। তবে প্রকৃতপক্ষে এসব সম্পত্তি কিনতে ক্রেতাদের ব্যয়ের পরিমাণ আরও অনেক বেশি হতে পারে।
অভিযোগ সূত্র বলছে, গত দুই বছরে দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের প্রপার্টি কেনার প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছে বাংলাদেশিরা, যার তথ্য তারা দেশে পুরোপুরি গোপন করেছেন। এমনকি বৈশ্বিক নেতিবাচক অর্থনীতির মধ্যেও দেশটির রিয়েল এস্টেট খাতের বিদেশি প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বাংলাদেশিরা শীর্ষে। এদিক থেকে নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, চীন ও জার্মানির মতো দেশগুলোর বাসিন্দাদের পেছনে ফেলেছেন বাংলাদেশিরা।
২০২০ সালে করোনার মধ্যেই দেশের নির্মাণ খাতের ঠিকাদারির সঙ্গে যুক্ত একজন ব্যবসায়ী দুবাই চলে যান। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। দেশের ব্যবসা থেকে উপার্জিত মুনাফা প্রতিনিয়ত দুবাইয়ে স্থানান্তর করছেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এখন যেকোনোভাবে হোক বিদেশ থেকে পুঁজির প্রবাহ বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে। এজন্য বিদেশি ধনীদের স্থানান্তরিত হতে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশও অর্থপাচার প্রতিরোধে কার্যকর ও শক্তিশালী কোনো ব্যবস্থা গড়তে না পারায় এখান থেকে দুবাইয়ে অর্থপাচার বেড়েছে।
ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির হিসাব অনুযায়ী, দুবাইয়ে মোট প্রপার্টির বাজার ব্যাপ্তি ৫৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের। এর মধ্যে ২৭ শতাংশ আছে বিদেশি মালিকানায়।
সম্প্রতি দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশি নাগরিকের সম্পদ কেনার বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসরণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গত ১৬ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুবীর নন্দী দাসের করা এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে দুবাইয়ে অবস্থানরত ৪৫৯ বাংলাদেশি নাগরিকের সম্পদ ক্রয়ের অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এ বিষয়ে দুদক, বিএফআইইউ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত করে অগ্রগতি প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াত লিজুর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই আদেশ দিয়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ গত বছরের মে মাসে তাদের গবেষণা প্রতিবেদনে উপসাগরীয় দেশগুলোতে পাচার করা অর্থ দিয়ে আবাসন সম্পদ কেনার বিষয়টি তুলে ধরে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তথ্য লুকিয়ে ৪৫৯ জন বাংলাদেশি দুবাইয়ে মোট ৯৭২টি আবাসন সম্পদের মালিক হয়েছেন। এজন্য তারা ব্যয় করেছেন ৩১৫ মিলিয়ন ডলার। এসব সম্পদের মধ্যে ৬৪টি দুবাইয়ের অভিজাত এলাকা দুবাই মেরিনা ও ১৯টি পাম জুমেইরাহতে অবস্থিত। যেখানে অন্তত ১০০টি ভিলা ও কমপক্ষে ৫টি ভবনের মালিক বাংলাদেশি বলে জানা গেছে। চার থেকে পাঁচজন বাংলাদেশি প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তির মালিক। যদিও প্রতিবেদনে কারো নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি।