শিকদার হাবিব, ঢাকা: বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়ার বিষয়টি অনেকটাই নিশ্চিত। তবে শেষ পর্যন্ত বিএনপি’র জন্য সরকারের তরফ থেকে ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত হলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রায় সব প্রস্তুতিই সরকার নিয়ে ফেলেছে। যদিও ৭ জানুয়ারি ঘোষিত তারিখে আদৌ নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়ে গেছে। কিন্তু এরই মধ্যে কোরবানীর ঈদের গরুর হাটের মতোই ‘ওয়ানম্যান শো’ রাজনৈতিক দলের নেতারা নিজেদেরকে গরুর মতোই নিলামে তুলেছেন।
দেশী-বিদেশী নানা চাপের মধ্যেও শেষ পর্যন্ত আগামী বছরের জানুয়ারির ৭ তারিখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যদিও এই মুহূর্তে বিএনপি’র প্রায় সব শীর্ষ নেতাকেই জেলে আটক করে রাখা হয়েছে। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে পশ্চিমা বিশ্বের শত আহবান সত্ত্¡েও সরকার এক তরফা নির্বাচনের সব প্রস্তুতি চূড়ান্ত করে ফেলেছে। তবে বিএনপি’র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুরণ না হওয়ায় তারা বর্তমান সরকারের অধীনে বিশেষ করে শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে আর কোনো নির্বাচনে অংশ না নেবার বিষয়ে অনড় রয়েছে। এখনও হরতাল-অবরোধ চলছে। হয়তো আগামী দিনগুলোতে আরও কঠোর কর্মসূচি তারা দিতে পারে বলে আগেই জানিয়ে রেখেছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি ঘরানার বা সমমনা ‘ওয়ানম্যান শো’ কিছু রাজনৈতিক নেতাকে অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই কিনে নিচ্ছে। কে কত টাকার বিনিময়ে নির্বাচনে অংশ নিবে সে সব বিষয়ও অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট।’ বিশেষ করে কেবলমাত্র বিএনপি’র উপর ভর করে বিগত কয়েক বছর ধরে যারা নিজেদেরকে সরকারবিরোধী বলে প্রচার করেছে তারাই নিজেদেরকে নিজেরাই অর্থের বিনিময়ে নিলামে তুলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উল্লেখ করা দরকার, এসব নেতাদের কোনো কর্মি নেই, সমর্থকও নেই। এমনকি দলের পূর্ণাঙ্গ কোনো কমিটিও নেই। কিন্তু তারপরও নানা নামের রাজনৈতিক দল করে পূর্ব পরিকল্পনার
অংশ হিসেবে তারা সরকারের সমালোচনা করে বিএনপি সমর্থকদের কাছে কম-বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপিকে দূর্বল করার অভিপ্রায়ে। একইসাথে পাচ্ছেন মোটা অংকের নগদ অর্থ এবং সংসদ সদস্য পদ পাবার শতভাগ নিশ্চয়তা। এই তালিকায় প্রথম ‘বিক্রি’ হওয়া ব্যক্তিটির নাম সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। তিনি একজন সাবেক মেজর জেনারেল। তার রাজনৈতিক দলের নাম বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। পার্টির নাম কল্যান হলেও এখন তিনি নিজের আর্থিক এবং ক্ষমতার ভাগ নেয়ার কল্যাণ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছেন না বলে অভিযোগ সাধারণ মানুষের। হাস্যকরভাবে তিনি গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, ‘সরকারের সঙ্গে আন্দোলনে না পেরে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।’ তার এই বক্তব্যে অনেকেই প্রশ্ন তুলে বলেছেন, তিনি কবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন? কবে, কোথায় তাকে সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে দেখা গেছে? যাকে কখনো রাস্তায়ই দেখা যায়নি তিনি আন্দোলনে হেরে গেলেন কিভাবে? সমালোচকরা বলছেন, সরকারের কাছে নিজেকে নিলামে তুলে ২০ কোটি টাকা নগদ এবং তিনটি আসন চেয়েছিলেন। একটি তার নিজের, একটি তার স্ত্রীর জন্য এবং অপর আসনটি তিনি আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিতে পারবেন বলেও সরকারের সাথে মৌখিক চুক্তি করেন। সরকার তাকে ১০ কোটি টাকা নগদ এবং দুটি আসন দিতে রাজী হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম গত জুন মাসে বলেছিলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচন জনগণ মেনে নেবে না। এই সরকারের পতন না হলে দেশে শান্তিও আসবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন আন্দোলনে তার দল সব সময়ই বিএনপি’র দাবির সাথে একমত বলেও তিনি জানিয়েছিলেন।’ এরমাত্র পাঁচ মাস না পেরুতেই তিনি এখন বলছেন, ‘এই সরকারের অধীনেই তিনি নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। মুক্তিযোদ্ধা এক সাবেক জেনারেলের এই নৈতিক অবক্ষয় ও অর্থের বিনিময়ে বিক্রি হওয়া দেখে অনেকেই তাকে কোরবানীর গরুর হাটের সবচেয়ে দূর্বল গরুর উচ্চমূল্য বলে অভিহিত করছেন।
বিএনপি’র একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৃদ্ধ এই জেনারেল বিএনপির পক্ষে থাকার জন্যও পাঁচ কোটি টাকা চেয়েছিলেন। কিন্তু টাকা দিয়ে তাকে পক্ষে রাখার মতো দৈন্যতা বিএনপি’র হয়নি বলে জানিয়ে দেয়া হয়। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সাথে যোগাযোগ করে নিজেকে ‘নিলামে’ তুলেন।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি’র সাথে বেশ কয়েক বছর ধরে সংশ্লিষ্ট আছে এমন আরও দুজনকে সরকার টার্গেট করেছে উচ্চমূল্যে কিনে নেয়ার জন্য। তবে তারা নিজেদেরকে হাটের গরুর মতো বিক্রি করে দিতে রাজী হননি বলে জানা গেছে। তাদের উপর অনেক চাপ দেয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, বিএনপিকে বাদ দিয়েই তারা নির্বাচন অনুষ্ঠান করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে নিজেদের দলের অন্তত ৭ হাজার প্রার্থী মনোনয়নপত্র কিনতে পারেন বলে তার ধারণা। যদিও একেকটি আবেদনপত্রের দাম ধরা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা করে। তারপরও এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার ফরম বিক্রি হয়েছে। সেখানে ‘নির্বাচনী হাটে তারা যে সব মৃতপ্রায় গরু’ কিনবেন তাদের কোনো খবরই থাকবে না নির্বাচনী মাঠে। অর্থাৎ তারা বিজয়ী হতে পারবে না কোনোভাবেই। এটা করা হচ্ছে কেবল বিএনপিকে কোনঠাসা করার জন্য।
বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, বিভিন্ন ছোটখাটো রাজনৈতিক দলের কিছু নেতাকে ‘কেনার’ জন্য সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে তারা নামকা ওয়াস্তে পরিচিত কিছু রাজনৈতিক দলের নেতাদের অর্থের বিনিময়ে কিনে ফেলবেন এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে বাধ্য করাবে বলে জানা গেছে। বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও একাধিক রাজনৈতিক দল যে অংশ নিবে বা নিয়েছে সেটা প্রমাণ করাই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য। তাছাড়া প্রয়াত এরশাদের সহোদর জিএম কাদের এবং তার মৃতপ্রায় পতœী রওশন এরশাদ তো সরকারের ট্রাম্প কার্ড হিসেবে রয়েছেই নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টায়।
সরকারী গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্র বলেছে, যাদের টার্গেট করা হবে তারা নির্বাচনে অংশ না নিলে পূর্বে রেকর্ডকৃত কিছু ভিডিও বাজারে ছাড়া হবে যেটা তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবন অতিষ্ট হওয়ার জন্য যথেষ্ট। সুতরাং এক তরফা এই নির্বাচনে বিগত বছরগুলোতে বিএনপির সাথে থাকা কেউ নির্বাচনে অংশ নিলে ধরে নিতে হবে ওই ব্যক্তির নারীঘটিত ভিডিও টেপ সরকারের হাতে রয়েছে। তৃনমূল বিএনপিতে এরই মধ্যে সরকারের তরফ থেকে পাওয়া বিপুল পরিমান অর্থের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।
এদিকে বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, যারা অর্থের বিনিময়ে দেশবাসীর সাথে বেঈমানী করে সরকারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিবে তারা ভোটারদের ঘৃনার পাত্রে পরিনত হবেন। জাতি তাদের বেঈমান হিসেবেই চিহ্নিত করবে।
স্বরণ করা যায়, গত দেড় দশক ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকলেও নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নির্বাচনে যেতে তারা রাজী নয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বসহ পৃথিবীর অনেক দেশই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার জন্য অনেকদিন ধরেই চাপ দিয়ে আসছে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে ইতিবাচক কোনো সাড়া না পেয়ে ভিসা নিষেধাজ্ঞাসহ আরও কিছু শর্ত এরই মধ্যে আরোপ করা হয়েছে। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বাংলাদেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেয়ার বিষয়টিও যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয় বিবেচনায় রেখেছে বলে জানা গেছে।
নির্বাচনী হাট জমজমাট: এক গরুর দাম ১০ কোটি!
নারীঘটিত ভিডিও টেপ প্রকাশের আতংঙ্ক
২৩১
previous post