রুনা খান : বাংলাদেশী ক্রেতারা ভালো-মন্দ যাচাই না করে সস্তা অফারের প্রলোভনে নিজ দেশের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন , দেশপ্রেম এবং প্রচার -প্রচারনার অভাবে বাংলাদেশীদের কটার্জিত অর্থ চলে যাচ্ছে ভিন্ন কমিউনিটির পকেটে।
শনিবার দুপুরে নিউজার্সি থেকে আসা একজন ক্রেতা আপনা বাজারের সামনে থেকে নানা ধরনের সব্জি ক্রয় করছিলেন। বাংলাদেশী মালিকানাধীন দোকান থেকে বাজার না করে কেনো অন্য জায়গা থেকে কেনা কাটা করছেন ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রথমত বাংলাদেশী দোকান মালিকরা কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা গ্রহণ করতে চায় না। মালিক না থাকলে কর্মচারিরা দূর্ব্যবহার করেন। এমনকি যদি অভিযোগ লেখার একটা খাতা থাকতো তাহলেও আমরা সেখানে যেতাম। তারা একজন কাস্টমারকে ‘একজন’ হিসেবে বিবেচনা করে। সে কারণেই আগের খারাপ অভিজ্ঞতার পর থেকে তিনি অন্য কমিউনিটির দোকান থেকে বাজার করেন বলে জানালেন। তবে তিনি মনে করেন, মালিকপক্ষ ক্রেতাদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বিবেচনায় নিলে তিনিসহ তাদের আত্মীয়-স্বজনরা বাংলাদেশী দোকান থেকেই কেনা-কাটা করতে আগ্রহী।
একই কথা জানালেন, পাটেল ব্রাদারর্সে কেনা-কাটা করা ওবায়েদ আলী। তিনি এসেছেন কানেক্টিকাট থেকে। ওবায়েদ আলী প্রতি সপ্তাহেই জ্যাকসন হাইটস’এ আসেন বাজার করতে। কিন্তু একবার জ্যাকসন হাইটস এর বাংলাদেশী মালিকানাধীন একটি বড় গ্রোসারী থেকে ৪০ কেজি গরুর মাংস কিনে নিয়ে যান। বাড়ি পৌঁছে দেখেন তার বেশিরভাগই খাওয়ার অযোগ্য হাড়। যদিও তিনি হাড় ছাড়া মাংসের দাম পরিশোধ করেছিলেন। এ নিয়ে পরের সপ্তাহে এসে দোকানের ম্যানেজারকে অভিযোগ করলে তিনি আরও দূর্ব্যবহার করেন তার সাথে। সামান্য দুঃখ প্রকাশের আশা করেছিলেন তিনি। সেটা না পেয়ে তার পর থেকে তিনি ইন্ডিয়ান দোকান থেকে কেনা কাটা করেন। তার যুক্ত ‘যদি নিজেদের দোকান থেকে কেনা কাটা করে ভুল ক্রটির কোনো সমাধান না পাই তাহলে আমি কেনো তাদেরকে নিজেদের দোকান মনে করবো ?
প্রায় একই ধরনের অভিযোগ পার্শ্ববর্তী স্টেট নিউজার্সি থেকে বাজার করতে আসা ইভানা খান, সুমন পাটোয়ারী, ইরাজ আহমেদ, নূরুল ইসলামসহ আরও অনেকের। তারা বাংলাদেশীদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে আগ্রহী। তবে সেবাটাও চান নিজেদের মতো করে। জ্যামাইকা এবং জ্যাকসন হাইটস’র একাধিক ব্যক্তি যারা নিজেরাও পাটেল ব্রাদ্রারস , আপনা বাজার বা মহারাজা থেকে কেনা কাটা করেন নিয়মিত। তাদের অভিযোগ ইন্ডিয়ার দোকানগুলোকে পণ্য সস্তা বলেই তারা সেখান থেকে কেনাকাটা করেন। পাশাপাশি অভিযোগ করে বলেন, পাটেল ব্রাদার্সে একটা শক্তপোক্ত বাজারের বড় সাইজের ব্যাগের দাম ৫০ পয়সা। অথচ তার চেয়ে একশ গুন খারাপ মানের একটা ব্যাগের দাম বাংলাদেশী দোকানে একই দাম রাখা হয়। যদিও ওইসব ব্যাগে বাজার ভরার পরেই ছিড়ে যায়। অথচ পাটেল বা আপনা বাজারের ব্যাগগুলো অনেক বেশি ভালো মানের। এসব বিষয় খুব ছোট হলেও দূর থেকে যারা বাজার করতে আসেন তাদের কাছে ব্যাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এটা বহুদূর বয়ে নিয়ে যেতে হয়।
ক্রেতাদের এসব বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে জ্যাকসন হাইটস’এ বাজার করতে আসা রোকসানা হক এবং হেমায়েত মিয়া বলেন, ‘অবশ্যই আমাদের সবাইকে বাংলাদেশী স্টোর থেকেই কেনা-কাটা করা উচিত। কারণ অন্যরা যে পন্য সন্তায় বিক্রি করছে তার আড়ালে থাকে ভিন্ন কারণ। বাংলাদেশী পন্য অধিকাংশই ভালো। কিছু সমস্যা থাকলেও সেটা উপেক্ষা করা উচিত বলে তারা মনে করেন। তাদের মতে, ‘আমাদের কষ্টের অর্থ কেনো আমরা অন্যের পকেটে তুলে দিবো ?’ তবে ‘আমরা কেনো বাংলাদেশী গ্রোসারীতে বাজার করতে যাই না সেটাও ব্যবসায়ীদের খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি আমাদেরকেও ভাবতে হবে নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য কেনো নিজেদের ব্যবসায়ীদের কাছে যাই না ?’
জ্যাকসন হাইটস’র খামার বাড়ির স্বত্বাধিকারী হারুণ ভ‚ঁইয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের জাতীয়তাবোধ অনেক সংকীর্ণ। নিজের দেশের স্বার্থ, ভালো-মন্দ বুঝার ক্ষমতা কম। কিন্তু ভারতীয়রা একবেলা না খেয়ে থাকতে হলেও অন্য দেশের দোকান থেকে এক ডলারের পণ্যও তারা কিনবে না। কিন্তু বাংলাদেশীরা সারাদিন আমাদের সাথে ঘুরাফিরা করে কিন্তু বাজারটা করে ইন্ডিয়ান দোকান থেকে। তিনি মনে করেন, এ ব্যাপারে সাংবাদিকরাও একটা বড় ভ‚মিকা রাখতে পারে। সারা বছর আমাদের দেশীয় পত্রিকাগুলোতে আমরা বিজ্ঞাপণ দেই। আমরাই তাদের সংবাদের সূত্র। অথচ ঈদ, রোজা, পূজা এলে তাদের দোকানের ছবি দিয়ে উৎসবের সংবাদ ছাপা হয়। আমাদেরকে হাইলাইটস করা হয় না। তিনি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, আমাদের বাংলাদেশীদের দোকানের পন্য বা সব্জি সবচেয়ে ভালো কোয়ালিটির। কিন্তু আমাদের পাশের ব্যবসায়ীরা নি¤œমানের সব্জি ‘দুই পয়সা’ কমে বিক্রি করছে বলে বাংলাদেশীরা সেখানে ভীড় করছে । এটা খুবই দুঃখজনক।’
এ ব্যাপারে বাংলাদেশী সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী বিসমিল্লাহ সুপার মার্কেটের স্বত্বাধিকারী আহসান হাবিব মনে করেন, ইন্ডিয়ান সুপার মার্কেটগুলো আমাদের চেয়ে একটু বড়। ক্রেতারা বড় দোকানে কেনা-কাটা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তবে যে পন্য তারা সস্তা মনে করে কিনছেন সেগুলো ‘বি’ অথবা ‘সি’ গ্রেডের। সেগুলো বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা কখনোই বিক্রি করে না। আহসান হাবিব মনে করেন, সামান্য কয়েক সেন্টস সাশ্রয় করার জন্য অনেকেই খারাপ পণ্য কিনে ঘরে নিচ্ছেন। কিন্তু সবকিছু যাচাই করে দেশপ্রেমের কথা মাথায় রেখেই সবার অর্থ খরচ করা উচিত। তিনি বলেন, ‘নিজের কষ্টার্জিত অর্থ যেনো আমরা না বুঝেই অন্যকে দিয়ে না দেই।’
জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, এস্টোরিা, ব্রঙ্কস, ব্রæকলিনসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, কেবলমাত্র জ্যাকসন হাইটস’র ইন্ডিয়ান সুপার মার্কেটগুলোতে বাংলাদেশী ক্রেতাদের ভীড় থাকে। এসব ক্রেতার অধিকাংশই সিটির বাইরে থেকে আসেন। অনান্য এলাকায় স্থানীয়রা সাধারণত বাংলাদেশী মালিকানাধীন গ্রোসারী থেকেই কেনা কাটা করে থাকেন। ছোট-বড় মিলিয়ে বাংলাদেশী মালিকানাধীন শ’খানেক গ্রোসারী ও সুপার মার্কেট থাকলেও বাংলাদেশীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ইন্ডিয়ান স্টোর থেকেই কেনা কাটা করে থাকেন। বিশেষ করে বড় ধরনের অনুষ্ঠান বা রোজা, ঈদের কেনাকাটা তারা ইন্ডিয়ান গ্রোসারী থেকে করতেই বেশি পছন্দ করেন। ফলে বাংলাদেশীরা যে অর্থ এই বাজারের পেছনে খরচ করেন তার বড় একটি অংশ বাংলাদেশীদের ব্যাংকে না গিয়ে চলে যায় অন্যদের ব্যাংকে।
তাছাড়া বাংলাদেশী মালিকানাধীন সুপার মার্কেট, গ্রোসারী, হোটেল, রেস্টুরেন্টে অনেক মানুষ কাজের সুযোগ পান যারা বাংলাদেশী না। কিন্তু ইন্ডিয়ান মালিকানাধীন কোনো স্টোরে একজন বাংলাদেশীকেও কাজ দেয়া হয় না। তারা মনে করে, অন্য দেশের একজনকে কাজ দেয়ার মানেই হচ্ছে তার দেশের একজন মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করা। একইসাথে বেতনের অর্থটাও চলে যাবে অন্য দেশের মানুষের পকেটে, যেটা বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা কমই চিন্তা করেন।
এদিকে জ্যাকসন হাইটস’র আপনা বাজারের সামনে নিজেদের খেয়াল খুশীমতো রাস্তা বন্ধ করে মালপত্র রেখে দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক ক্রেতা এবং পথচারী। তাদের অভিযোগ পথচারীদের চলাচলের রাস্তা বন্ধ করে প্রকাশ্যে তারা নিয়মিতভাবে এই অন্যায় কাজটি চালিয়ে গেলেও এ নিয়ে কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। একাধিক পথচারী ও বাজার করতে আসা মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলে একাধিক সংগঠনের জন্ম হলেও তারা এখানে কেনা-কাটা করতে আসা মানুষের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে নিশ্চুপ। জেবিবিএ’র একাধিক সদস্যও ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছেন, তারা কি শুধু নেতা হলেই হবে ? জ্যাকসন হাইটস এলাকার সুবিধা অসুবিধাগুলোও তাদের কাজের মধ্যে পড়ে। এটাও তাদের মনে রাখা দরকার।