জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার থেকে পাঁচ কোটি ভোটারের তথ্য চুরি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে এসব ভোটারদের নিজেদের পক্ষে রাখার কৌশল মাথায় রেখেই এই তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি যাওয়া তথ্যের সূত্র ধরে সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্যই সরকারী সহায়তায় এই বিপুল পরিমান ভোটারের তথ্য নিজেদের কব্জায় নেয়া হয়েছে। তথ্য চুরির পরিকল্পনা মাথায় রেখেই জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার একাধিক সংস্থার সাথে শেয়ার করা হয়েছিলো। যাতে করে ঠিক কোথা থেকে এই তথ্য চুরি হলো সেটা যেনো বুঝা না যায়।
সম্প্রতিক সময়ে টেলিগ্রামের এনআইডি ইনফরমেশন শীর্ষক চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্য ফাঁসের বিষয়টি ব্যবহারকারীদের নজরে আসে। বিষয়টি বিজিডি ই-গভ সার্ট থেকে নির্বাচন কমিশনকে জানানো হয়। এরপর ইসি বুধবার রাত একটা থেকে সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য দেওয়া বন্ধ করে। এ ঘটনায় সন্দেহজনক মনে হওয়ায় ভূমি মন্ত্রণালয়কে এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এরপর থেকে টেলিগ্রামের যেই চ্যানেল থেকে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পাওয়া যেত সেখান থেকে এখন আর তথ্য মিলছে না। এদিকে এ ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
উল্লেখ্য, এর আগে গত জুলাই মাসে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিকের তথ্য ফাঁস হয়। ওই ঘটনায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার কার্যালয়কে দায়ী করা হয়েছিলো। ওই প্রতিষ্ঠানটিও জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডার থেকে নাগরিকদের তথ্য যাচাই করত। ওইসব তথ্য তারা সংরক্ষণও করেছিল।
এদিকে, বন্ধ করার আগ পর্যন্ত টেলিগ্রামের চ্যানেলটিতে যে কারো এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখ দিলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নাম, পিতা, মাতা, স্বামী/স্ত্রীর নাম, জন্মতারিখ, ধর্ম, লিঙ্গ, ফোন নম্বর, বর্তমান ঠিকানা ও স্থায়ী ঠিকানা এবং ছবি পাওয়া যাচ্ছিল। ওই ঘটনা জানাজানি হলে সন্দেহভাজন হিসাবে জন্ম-নিবন্ধন কার্যালয়ের পাশাপাশি ভূমি মন্ত্রণালয়কেও তথ্য সেবা দেওয়া বন্ধ রাখে ইসি।
জনদুর্ভোগের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং তাদের ওয়েবসাইটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের শর্তে পুনরায় সেবাটি চালু করে দেয় ইসি। এবার টেলিগ্রামের একটি চ্যানেলে তথ্য প্রকাশের পর আবারও ভূমি মন্ত্রণালয়কে তথ্য যাচাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, ইসি থেকে বৃহস্পতিবার ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবকে এই বিষয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে দায়ী ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে এবং বিষয়টি তদন্ত করে প্রতিবেদন ইসিতে পাঠাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইটি টিম ও ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের যারা এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের সঙ্গে জড়িত এমন কর্মকর্তাদের গোয়েন্দা সংস্থা থেকে নিরাপত্তা ছাড়পত্র নিয়ে ইসিতে জমা দিতে বলা হয়েছে।
যদিও এ বিষয়ে অভিঙ্গ অনেকেই নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সরকার নিজেই এসব তথ্য চুরি করেছে। কারণ এর মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে আগামী নির্বাচনে সরকারের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা চালাতে সুবিধা হবে। কারণ সংসদ নির্বাচন যদি কোনো অস্থায়ী সরকারের অধীনে হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনে সরকারের আর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। ফলে তারা ইচ্ছা করলেই আর কারো তথ্য নিজেদের কাজে লাগাতে পারবে না। উল্লেখ করা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনট নির্বাচনের সময়ও ভোটারদের তথ্য চুরি করে তৃতয়ি একটি পক্ষ ভিন্ন দেশ থেকে ট্রাম্পের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালায় সোস্যাল মিডিয়ায়। আর এই প্রচারণা ট্রাম্পের পক্ষে ইতিবাচক ফলাফল দিয়েছিলো।
এই বিষয়ে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর অবশ্য তথ্য ফাস বা চুরির কথা স্বীকার করেননি। তিনি বলেছেন, তাদের তথ্য ভান্ডার থেকে ভোটারদের কোনো তথ্য চুরি হয়নি। অবম্য তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান আমাদের তথ্যভান্ডার থেকে এনআইডির তথ্য নিয়ে থাকে, তার মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য এক জায়গায় করে সেগুলো ফাঁস করতে পারে। কতটি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনই এটা বলা যাবে না। আমরা দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলতে পারব।
তথ্য ফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এনআইডির তথ্য নেওয়া প্রতিষ্ঠান থেকে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এরই মধ্যে তথ্য দেওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
এভাবে বারবার তথ্য ফাঁস হওয়ায় নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লংঘন হচ্ছে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি একটু উত্তেজিত হয়ে বলেন, প্রাইভেসি বলে কিছু নেই। প্রাইভেসি কোথায় আছে? পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরির আবেদন করতে যখন সব তথ্য দেওয়া হয় তখন কি ওই প্রার্থীর প্রাইভেসি থাকে? যখন নিকাহ নিবন্ধন করেন তখন কি প্রাইভেসি থাকে? টেকনোলজির যুগে প্রাইভেসি বলতে কিছু থাকে না।’
একই সাথে তিনি বলেন, ইসি’র কাছ থেকে কিছু চুরি হয়নি। ইসি’র টেকনিক্যাল দিকটা খুব স্ট্রং। আমরা সব সময় এটা মনিটর করি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য ফাঁস হয়েছে তার প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, টেলিগ্রাম চ্যানেল থেকে তথ্য বেহাতের বিষয়টি নজরে আসার পর বিজিডি ই-গভ সার্ট থেকে ইসিকে জানানো হয়। এরপর যাচাই করে ভূমি মন্ত্রণালয়কে এনআইডি সেবা দেওয়া বন্ধ রাখে ইসি। বর্তমানে ১৭৫টি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইসির সার্ভার থেকে নির্ধারিত ফি দিয়ে এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের সেবা নিচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ইসির দেওয়া এপিআই-এর মাধ্যমে এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের সেবা নিয়ে থাকে। ভূমি মন্ত্রণালয় নামজারি, জমি ও ফ্ল্যাট বিক্রির রেজিস্ট্রেশনের কাজে নাগরিকের এনআইডির তথ্য যাচাই করে থাকে।
এনআইডি শাখার মহাপরিচালক একেএম হুমায়ুন কবীর জানান, ‘এনআইডি সার্ভার নিরাপদ আছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চ গত ৭ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিলো, একটি সরকারি ওয়েবসাইট থেকে প্রায় পাঁচ কোটি বাংলাদেশি নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস বা চুরি হয়েছে।’
আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তখন বলেছিলেন, সরকারি সংস্থা রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সার্ভারের মাধ্যমে এই তথ্য ফাঁস হয়েছে। ফাঁস হওয়া তথ্যের নাগরিকদের নাম, ফোন নম্বর, ইমেল ঠিকানা ও জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর রয়েছে।
পাঁচ কোটি ভোটারের তথ্য চুরি ‘সরকার নিজেই জড়িত বলে সন্দেহ’
৬৬
previous post