ঢাকা অফিস: বাংলাদেশে চলছে তীব্র ডলার সংকট। ডলারের অভাবে পণ্য আমদানীর এলসি খোলা যাচ্ছে না। বৈদেশিক মূদ্রার প্রবাহ কমে যাওয়ায় টাকার বিপরীতে ডলারের দাম প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে। অন্যদিকে পাল্লা দিয়ে কমছে বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ। এক বছরেই রিজার্ভ কমে গেছে ২৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ২০২১ সালে যে ডলারের দাম ছিলো ৮৪ টাকা, সেই ডলার এখন ১২৪ টাকায় দাঁড়িয়েছে। চলতি মাসের মধ্যেই ডলারর দাম বেড়ে ১৫০ টাকা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে বুধবার দেশের ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদার যৌথ সভায় কোনোভাবেই ১১৫ টাকার বেশি ডলারের দর দেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। প্রবাসী আয়ে ব্যাংকের নিজস্ব প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২২ টাকার বেশি দর দেওয়ার তথ্য প্রকাশের পর জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
উল্লেখ্য নানা ধরণের উদ্যোগ নেওয়ার পরও বাংলাদেশে ডলার সংকট কমছে না বরং বেড়েই চলেছে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা গত ১ সেপ্টেম্বর প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা বাড়িয়ে রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় নির্ধারণ করে। এর সঙ্গে রেমিট্যান্সে ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে প্রণোদনা দিতে পারবে বলে জানানো হয়। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক এ দরে ডলার পাচ্ছে না। এখন ১২২ টাকা ৫০ পয়সা পর্যন্ত দরে ডলার কিনছে অনেক ব্যাংক।
করোনার পর অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা এবং অর্থপাচার ব্যাপকহারে বেড়ে যাওয়ায় হুন্ডিতে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। এতে করে ডলারের দর বেড়ে গত বছরের মাঝামাঝি ১১৪ টাকায় ওঠে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্ততায় গত বছরের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দর ঠিক করে আসছে ব্যাংকগুলো। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শুরুতে ডলারের দর রেমিট্যান্সে ১০৮ এবং রপ্তানিতে ৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পর্যায়ক্রমে উভয় ক্ষেত্রে ডলার কেনার দর অভিন্ন করা হয়। অনেক ডলার বিক্রির প্রতিষ্ঠান বন্ধও করে দেয়া হয় নানা অভিযোগ তুলে। কিন্তু এই অবস্থায় প্রয়োজনে যারা বিদেশে যাবে তাদের জন্য ডলার সাথে নেয়ার বাধ্য বাধকতা থাকার কারণে অনেকেই বিদেশে যেতে পারছে না। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা নগদ ডলারে অভঅবে দেশের বাইরে পড়তে যেতে পারছে না।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দর ঠিক করার পাশাপাশি রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করে আসছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি অর্থবছর এরই মধ্যে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের মতো বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছর বিক্রি করা হয় ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার। এর আগের অর্থবছর ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়।
অন্যদিকে, এক বছর আগে ঘোষিত দরের চেয়ে ১-২ টাকা বেশি দামে রেমিট্যান্সের ডলার কেনায় ছয়টি ব্যাংকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। একই অভিযোগে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এসে আরো ১০টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে জরিমানা করা হয়েছিল। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই ব্যাংকগুলো এখন ঘোষিত দরের চেয়ে ১২ থেকে ১৪ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে ডলার কিনছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের সংকট আরো তীব্র হয়ে ওঠার কারণেই ব্যাংকগুলো মুদ্রাটি সংগ্রহে এতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদিত দর অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আনার জন্য ব্যাংকগুলোর ডলারপ্রতি সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দেয়ার কথা। যদিও দেশের অনেক ব্যাংকই এখন ডলারপ্রতি ১২৪ টাকা ৩৫ পয়সা পর্যন্ত পরিশোধ করছে। ব্যাংকগুলো এখন খুচরা বাজারের (কার্ব মার্কেট) চেয়েও বাড়তি দরে ডলার সংগ্রহ করছে। কার্ব মার্কেটে গতকাল প্রতি ডলার লেনদেন হয়েছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকায়। তবে এখানেও বুধবার পর্যন্ত ডলারের তীব্র সংকট ছিল বলে জানিয়েছেন গ্রাহকরা।
দেশের অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা বণিক বার্তার সূত্র বলছে, দেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বুধবার মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জগুলো প্রতি ডলার ১২২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২৩ টাকা ৬০ পয়সা পর্যন্ত প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ লেনদেনই হয়েছে ১২৩ টাকার বেশি দরে। আন্তর্জাতিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্রান্সফাস্টের’ কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১২৪ টাকা দরেও রেমিট্যান্সের ডলার কিনেছে দেশের অনেক ব্যাংক। আর যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘ট্যাপট্যাপ’ থেকে সংগ্রহ করা ডলারের বিনিময় হার ছিল ১২৩ টাকা ৫০ পয়সা। সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ‘জিসিসি এক্সচেঞ্জ’ থেকেও একই দরে রেমিট্যান্স কিনেছে দেশের ব্যাংকগুলো।
ব্যাংকগুলো যে দামে ডলার কিনছে, তার চেয়ে ১-২ টাকা বেশি দামে আমদানিকারকদের কাছে বিক্রি করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রতি ডলারের বিনিময় হার গ্রাহকভেদে ১২৫ টাকায় গিয়েও ঠেকছে এরই মধ্যে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) থেকে এখন ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। সংগঠন দুটির বেঁধে দেয়া দর অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৫০ পয়সায় রফতানি ও রেমিট্যান্সের ডলার কেনার কথা। আর আমদানিকারকদের কাছে ডলার বিক্রির কথা সর্বোচ্চ ১১১ টাকায়। যদিও ঘোষিত এ দরের কোনো প্রতিফলন বাজারে দেখা যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলারের ঘোষিত দরের সঙ্গে বাজার পরিস্থিতির কোনো সামঞ্জস্য নেই। এ কারণে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) পরিশোধের জন্য অনেক বেশি দামে রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জগুলো ডলারের যে দর প্রস্তাব করছে, সেটি ঘোষিত দরের চেয়ে ১২-১৪ টাকা বেশি। ব্যাংকগুলো যদি ওই দামে ডলার না কেনে, তাহলে রেমিট্যান্সের বড় অংশ হুন্ডিতে চলে যাবে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহে বড় বিপর্যয়ে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা রেমিট্যান্সের প্রায় অর্ধেকই আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির মাধ্যমে। বুধবার এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে ব্যাংকটি ডলারপ্রতি ১২৩-১২৪ টাকায় রেমিট্যান্স কিনেছে। চলতি নভেম্বরের প্রথম পাঁচদিনে ব্যাংকটি রেমিট্যান্স কিনেছে প্রায় ৫ কোটি ডলার। এ রেমিট্যান্সের পুরোটাই ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি দরে কেনা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বলেন, ‘বড় ব্যাংক হওয়ায় আমাদের ডলারের চাহিদা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাহিদার আলোকে রেমিট্যান্সের ডলার কিনতে বলেছে। বিদেশী মানি এক্সচেঞ্জগুলো এখন ডলারপ্রতি ১২৩-১২৪ টাকা পর্যন্ত প্রস্তাব করছে। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী আমরা রেমিট্যান্স কিনতে বাধ্য হচ্ছি।’
দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ার শুরু গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই সময় আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দেয়া হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোয় বিশেষ পরিদর্শন চালায় বাংলাদেশ ব্যাংক। বেশি দামে ডলার বেচাকেনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে দেশী-বিদেশী ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধানকে অপসারণের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এসব তৎপরতার মুখে গত বছরের সেপ্টেম্বরে এক ধাক্কায় রেমিট্যান্স ৫০ কোটি ডলার কমে যায়। ২০২২ সালের আগস্টে ২০৩ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে এলেও সেপ্টেম্বরে তা ১৫৩ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। এরপর থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখনই ডলারের বিনিময় হার নিয়ে কঠোর হয়েছে, তখনই বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় দেখা গেছে।
সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৩৩ কোটি ডলার, যা ছিল ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ব্যাংকগুলোকে যেকোনো মূল্যে রেমিট্যান্স আনার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এতে গত মাসে (অক্টোবর) দেশের রেমিট্যান্স বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলারে। মূলত ঘোষিত দরের চেয়ে অনেক বেশি পরিশোধের কারণেই গত মাসে রেমিট্যান্সে বড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেও প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রয়েছে।
একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো এলসি দায় পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার সহায়তা পাচ্ছে। এ কারণে তাদের মধ্যে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতার কোনো মানসিকতাই নেই। আর বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে। বণিকবার্তার রিপোর্টে আরও জানা যায়, প্রত্যাশিত মাত্রায় রেমিট্যান্স না আসায় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষয় বেড়েই চলছে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী (বিপিএম৬) গতকাল দেশের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। সে হিসাবে গত দুই বছরের ব্যবধানে রিজার্ভের পরিমাণ নেমেছে অর্ধেকেরও অনেক নিচে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাংকগুলোর আমদানি দায় পরিশোধের জন্য প্রতি মাসে রিজার্ভ থেকে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়েও রিজার্ভের ক্ষয় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় যেকোনো উপায়ে রেমিট্যান্স বাড়ানো ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে কোনো উপায় নেই।
এসব বিষয়ে দেশের অর্থনীতিবিদদের অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, চলতি নভেম্বর মাসের মধ্যেই ডলারের বিপরীতে টাকার দাম ১৫০ টাকা হতে পারে। আর বছর শেষে এই দাম ডলারের বিপরীতে ২০০ টাকা হবার আশঙ্কা রয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠাতে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছেন না। আর অনাগ্রহ নির্বাচনের তপসিল ঘোষনার পর আরও বাড়তে পারে। কারণ নির্বাচনী সংঘাত আরও অনেক বেড়ে যেতে পারে বছরের শেষ দিকে।