আদনান চৌধুরী : রাশিয়া বা পুতিনের জন্য ন্যাটো এখন বিষফোঁড়া। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা আর বাড়তে দিতে চায় না পুতিন। পুতিন মনে করছেন, ন্যাটো ধীরে ধীরে রাশিয়াকে ‘গিলে’ খেয়ে ফেলবে। আর ন্যাটোভ‚ক্ত দেশগুলো মনে করছে রাশিয়াকে থামাতে না পারলে তাদের জোটের উপর রাশিয়া যে কোনো সময় থাবা বিস্তার করতে পারে। মূলত উভয়ের প্রতি উভয়ের ভয় আর অবিশ্বাস নিয়েই ইউক্রেন-রাশিয়া সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। ইউক্রেনের ভৌগলিক অবস্থান দুই পক্ষের জন্যই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইউক্রেনের বর্ডার এলাকা রাশিয়া এবং ইউরোপের একাধিক দেশের সাথে লাগোয়া। আর সে কারণেই ইউক্রেনকে রক্ষা করতে চাইছে সামরিক জোট ন্যাটো আর জোটের বাইরে রাখতে চাইছে রাশিয়া। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হতে পারে এই আশংকা থেকেই রাশিয়া ইউক্রেনকে চাপে রাখতে চাইছে। সদস্য না হলেও ইউক্রেন ন্যাটোর কিছু সুযোগ সুবিধা ও কর্মকান্ড এখনও পরিচালনা করছে তার দেশে।
১৯৩৯ সালে বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিলো তার সমাপ্তি হয়েছিলো ছয় বছর পর ১৯৪৫ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও পশ্চিমারা অনুভব করেছিলো শান্তিপ্রিয় দেশ ও জাতির জন্য নিজেদের রক্ষার স্বার্থে একটি সামরিক জোট গঠন করা জরুরী। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন দিনদিন আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছিলো সারাবিশ্বে। এই বাস্তবতায় যুদ্ধ শেষ হবার চার বছর পর ১৯৪৯ সালে একটি শক্তিশালী সামরিক জোট গঠনের চিন্তা করা হয়। সেই অনুযায়ী ১৯৪৯ সালের এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স এবং আটটি ইউরোপীয় দেশকে সাথে নিয়ে এক দেশ অন্য দেশকে রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার অঙ্গিকার নিয়ে জন্য উত্তর আটলান্টিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল ১২টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশ । উত্তর আটলান্টিক নিরাপত্তা জোট বা ‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি’ হচ্ছে ন্যাটো। প্রকৃতপক্ষে ন্যাটো হচ্ছে একে অপরের সামরিক সহযোগিতার জোট। এই জোটে ইউক্রেন ২০২০ সালের জুন মাসে থেকে কিছু প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। তবে এখনও জোটের সদস্য হতে পরেনি। আর তখন থেকেই রাশিয়ার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউক্রেন। রাশিয়া চাচ্ছে না এই দিকে ন্যাটো তার জোটের পরিধি আরও বাড়াক।
কিন্তু এরই মধ্যে ধীরে ধীরে ১২ থেকে বেড়ে এই সামরিক জোট এখন ৩০ সদস্যের এক শক্তিশালী পরিবার । ন্যাটো নামে পরিচিত এই সামরিক জোটই হচ্ছে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট বা শক্তি। ন্যাটো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের হাত থেকে পশ্চিম বার্লিন এবং ইউরোপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ন্যাটো একটি যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি, যে চুক্তির আওতায় জোটভুক্ত দেশগুলো পারস্পরিক সামরিক সহযোগিতা প্রদানে অঙ্গীকারাবদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার পর ন্যাটো তাদের রক্ষায় মাঠে নামে। এর প্রত্যেকটি সদস্য রাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীকে যে কোনও পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তত রাখকে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। সর্বশেষ ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্রগুলো হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, বেলজিয়াম, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, আইসল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ইতালী, লাটভিয়া, গ্রীস, হাঙ্গেরি, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ, এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া, মন্টিনেগ্রো, উত্তর মেসোডোনিয়া, নরওয়ে, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়া, রোমানিয়া, তুরস্ক, স্পেন এবং ক্রোয়েশিয়া ।
ন্যাটো জোট নেতারা বারবার রাশিয়াকে ইউক্রেনে হামলা না করতে নিবৃত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু তারপরও সত্যিই যদি শেষ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালায় তাহলে যেসব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে, অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা বন্ধ করে দেয়া। বিশেষ করে ব্যাংকিং লেনদেনে বিশ্বজুড়ে আমেরিকান সুইফট সিস্টেম অত্যন্ত কার্যকর একটি ব্যাপার। যুদ্ধ শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র এই সিস্টেম বন্ধ করে দিবে। একইসাথে যুক্তরাষ্ট্র সাগরের তলদেশ দিয়ে যে গ্যাস পাইপ লাইন নির্মানের কাজ রাশিয়া করছে সেটিও বন্ধ করে দেয়া হবে। উল্লেখ করা দরকার, জার্মানীতে গ্যাস সরবরাহের জন্য সাগরের তলদেশ দিয়ে রাশিয়া যে পাইপ লাইন বসানোর কাজ করছে তার নাম দেয়া হয়েছে ‘ নর্ডস্ট্রিম টু।’ এতসব উত্তেজনার মধ্যে বিশ্বের অন্তত এক ডজন দেশ ইউক্রেন থেকে এরই মধ্যে তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরে যাবার জন্য বলেছে। তার মানে হচ্ছে রাশিয়ার হুমকির মুখে ইউক্রেন এখন আর তাদের জন্য নিরাপদ না। কারণ পশ্চিমা দেশগুলো মনে করছে রাশিয়া একেবারে যুদ্ধ শুরুর শেষ মুহুর্তে আছে। যে কোনো সময় তারা ইউক্রেনে হামলা করতে পারে।
তবে রাশিয়া হামলা চালালে প্রথমেই যে তারা বিমান দিয়ে হামলা শুরু করবে সে ঈঙ্গিতও দিয়েছে তারা। রাশিয়াকে নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিলেও পশ্চিমা দেশগুলোও কিন্তু এই একই কারণে বহু ক্ষতির মুখে পড়বে। অর্থনৈতিক লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম সুইফট সিস্টেম বন্ধ করে দিলে কেবল রাশিয়াই ক্ষতিগ্রস্থ হবে না। পাশাপাশি অন্য দেশগুলোও ক্ষতির মুখে পড়বে বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন । তাদের মতে এর ফলে সবগুলো দেশ এমনকি সারা বিশ্বেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ন্যাটোর মুরুব্বী দেশগুলো রাশিয়া এমনকি ব্যাক্তিগতভাবেও পুতিনের উপর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে মত দিচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনান্য নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি পুতিনের উপরও নিষেধাজ্ঞা দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, শুধুমাত্র রাশিয়া বা পুতিন নয়, ক্রেমলিনের সাথে ঘনিষ্ট সব দেশের বিরুদ্ধেই তাদের নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে। তবে যুদ্ধের সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। তা সত্তে¡ও ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়র বিপুল পরিমান সৈন্য সমাবেশকে যুদ্ধের ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে বারবার সতর্কতা জারি করছে পশ্চিমা দেশগুলো। ২০২০ সাল থেকে ন্যাটোর সাথে যুক্ত হবার চেষ্টার মূল কারণ হচ্ছে ২০১৪ সালে রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনের দক্ষিনাঞ্চলের বড় একটি অংশ দখল করে নেয়া। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া সমর্থিত প্রেসিডেন্টকে ইউক্রেন ক্ষমতাচ্যুত করার পর পরই রাশিয়া ওই এলাকা দখল করে নেয়। এ ছাড়াও রয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহী বাহিনী। যারা ইউক্রেনে সরকারের বিরুদ্ধে দেশের ভেতরে থেকেই ইউক্রেনের উত্তরাঞ্চলের বড় একটি অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। চতুর্মুখী সমস্যায় জর্জড়িত ইউক্রেন মনে করছে ন্যাটো জোটে যোগ দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো গত্যান্তর নেই। কিন্তু রাশিয়া মনে করছে ইউক্রেন ন্যাটো জোটে ঢুকে গেলে সেখানে ন্যাটোর ঘাঁটি হলে রাশিয়ার নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন মনে করেন, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাদের মূল ভ‚খন্ডের অনেক জায়গা এমনিতেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। সে সব জায়গা বা দেশে এখন রুশ বিরোধী নানা কর্মকান্ড চলছে।
২০১৫ সালে পূর্ব ইউক্রেন নিয়ে মিনস্ক চুক্তি নামে আন্তর্জাতিক যে সমঝোতা হয়েছিলো সেটাও লঙ্ঘন করা হচ্ছে বলে পুতিনের অভিযোগ। তার মতে রাশিয়া এবং ইউক্রেন এক ও অভিন্ন একটি জাতি। রাশিয়া মনে করে ইউক্রেন যদি এখন ন্যাটোর জোটভ‚ক্ত সামরিক জোটের অংশিদার হয় তাহলে এই জোট রাশিয়ার দখলিকৃত ইউক্রেনের ক্রিমিয়া আবারও তাদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করবে। আর সে জন্য রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই বিভাকভ বলেছেন, ‘আমরা অবশ্যই এটা নিশ্চিত হতে চাই যে, ইউক্রেন কখনোই ন্যাটোর সদস্য হতে পারবে না।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আরও একধাপ বাড়িয়ে বলেছেন, ‘কেউ ইউক্রেনের পক্ষে যৌক্তিক কারণ ছাড়া সমর্থন দিলে, উত্তেজনায় ঘি ঢাললে আমরা চুপ করে বসে থাকবো বলে মনে করলে সেটা ভুল হবে।’ তার অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটোভ‚ক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছে। রাশিয়া চাইছে ১৯৯৭ সালের আগে ন্যাটোর যে সীমানা ছিল এই জোটকে আবারও সেখানেই ফিরে যেতে হবে। তারা দাবি করছে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণ এবং সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। রাশিয়ার এই কথার মানে হচ্ছে, পোল্যান্ড এবং সাবেক তিন সোভিয়েত রিপাবলিক লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া এবং লাটভিয়া থেকে ন্যাটো সৈন্য সরাতে হবে এবং পোল্যান্ড এবং রোমানিয়ার মতো দেশ থেকে ন্যাটোর মোতায়েন করা ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে ফেলতে হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন আবারও সবাইকে বলেছেন, ১৯৯০ সালে পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটো “আর এক ইঞ্চিও পূর্বে এগোবে না” বলে যে প্রতিশ্যুতি দিয়েছিলো সেই প্রতিশ্রæতি তারা রক্ষা করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগেই সেই প্রতিশ্রিæতি দেয়া হয়েছিলো বলে জানান তিনি। গর্ভাচেভ তখন জীবিতই ছিলেন। সুতরাং এটা নিয়ে পশ্চিমারা তাদের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করেছে বলেও পুতিনের অভিযোগ। তবে ন্যাটো জোটভ‚ক্ত পশ্চিমারা পুতিনের এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন অভিহিত করে বলেছেন, ‘ এ ধরনের একটি প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছিলো পূর্ব জার্মানী নিয়ে। তাদের মতে, গর্ভাচেভ জীবিত অবস্থাতেই বলেছেন ‘ পশ্চিমাদের সাথে ন্যাটো সম্প্রসারণ নিয়ে কোনো আলোচনা কখনোই তার হয়নি পশ্চিমাদের সাথে।
এদিকে ইউক্রেন সীমান্তে যখন যুদ্ধের দামামা বাজছে তখন একটি আলোচনা সামনে এসেছে। আর তা হচ্ছে যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে ইউক্রেনের এই যুদ্ধের সাথী কে কে আছে ? কারণ এরই মধ্যে ইউক্রেন রাশিয়ার আক্রমনের মুখে ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছে সামরিক ও প্রতিরক্ষামূলক সহায়তা চেয়েছে । কিন্তু এই আহবানে অনেকেই প্রকাশ্যে এখনও কিছু বলেনি। যদিও ন্যাটো জোট রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা হুমকি ধামকি দিয়েই চলেছে। লুক্সেমবার্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জিন অ্যাসেলবর্ন বলেছেন, ‘রাশিয়ার সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের মধ্য ইউক্রেনের পক্ষে শুধু অস্ত্র পাঠানোই ভারসাম্যপূর্ণ হতে পারে এমন ধারণা ভুল।’ ইউক্রেনে অবশ্য সামরিক সাহায্য পাঠাতে এই অনীহা নিয়ে হতাশাও রয়েছে অনেকের। জার্মান প্রকাশ্যে ইউক্রেনের বিরোধিতা করেছে। আবার এক কথাতেই অস্ত্র দিতে রাজি হয়ে গেছে ৩ বাল্টিক দেশ লাটভিয়া, এস্তোনিয়া ও লিথুয়ানিয়া । ন্যাটোর দুই সদস্য রাষ্ট্র পোলান্ড ও চেক প্রজাতন্ত্র সাহায্যের সম্মতি জানিয়েছে। পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মাতেউস মোরাউইকি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনে অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছেন এরই মধ্যে। তার ঘোষণায় রয়েছে, বিপুল পরিমান বুলেট, আর্টিলারি গোলাবারুদ, ম্যানপ্যাডস, হালকা মর্টার, রিকনেসান্স ইউএভি এবং অন্যান্য প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র। কিন্তু এর বিপরীতে কোনো শর্ত আছে কিনা তা জানা যায়নি এখনও। দেশটির শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইয়াগো রড্রিগেজ বলেছেন, ‘এটা বিশ্বাস করা উচিত যে, ওয়ারস ইতোমধ্যে কামিকেইজ ড্রোন পাঠিয়েছে, যা গোলাবারুদে পরিপূর্ণ।’ রাশিয়ার আগ্রাসনের হুমকির মুখে ইউক্রেনকে সমর্থনের অংশ হিসাবে চেক প্রজাতন্ত্র গতমাসে বেশ কিছু মর্টারশেল সরবরাহ করেছে। চেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের ভিত্তিতে ইউক্রেনে বিনা খরচে প্রায় দুই মিলিয়ন ডলার মূল্যের ৪ হাজার ‘ ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ১৫২ মিলিমিটার শেল’ স্থানান্তর অনুমোদন দেয়া হয়। যুদ্ধ সরঞ্জাম দেবে তিন বাল্টিক রাষ্ট্র লিথুনিয়া, লাটভিয়া এবং এস্তোনিয়া। লাটভিয়া এবং লিথুয়ানিয়া স্টিংগার অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ক্ষেপণাস্ত্র এবং এ সম্পর্কিত সরঞ্জাম সরবরাহের প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। বিপুল পরিমাণ জ্যাভলিন অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল দেবে এস্তোনিয়া। তবে জার্মান সরকার ইউক্রেনে এই অস্ত্র সরবরাহের জন্য এস্তোনিয়ার অনুরোধের অনুমতি বিবেচনা করছে। এই উত্তেজনার মধ্যেই ইউক্রেনে ৫০০০ হেলমেট পাঠিয়েছে বার্লিন। রড্রিগেজ বলেছেন, ‘এটি জার্মানির অনুল্লেখযোগ্য সহায়তা। বরং বলা যেতে পারে এর পেছনেও রাজনীতি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে অর্থনৈতিক সাহায্যই যথেষ্ট ছিল। এর মানে হচ্ছে কোনো মূল্যে ইউক্রেনের পাশে দাঁড়াতে রাজি না হওয়া।’ বার্লিন আগামী কয়েক বছরে কিয়েভকে ২ বিলিয়নের বেশি ইউরোর অর্থনৈতিক সহায়তার প্রস্তার দিয়েছে। যদিও তারা সম্প্রতি ঘোষণা করেছে-পূর্ব ইউরোপে ন্যাটো যুদ্ধ গোষ্ঠীগুলোতে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠাবে।
এদিকে এই যুদ্ধাবস্থার মধ্যেই স্পেন কৃষ্ণ সাগরে ফ্রিগেট এবং ফাইটার জেট সরবরাহ শুরু করেছে। হল্যান্ড এবং ডেনমার্ক রাশিয়াকে সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে বিরত রাখার জন্য ন্যাটোর অন্যান্য দেশে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। রড্রিগেজ বলেন, ‘এটা ভাবা যায় না যে ইইউ ইউক্রেনকে তার সীমান্ত রক্ষায় সামরিকভাবে সাহায্য করতে পারে। এটা ইইউ চুক্তির পরিপন্থী।’ কিয়েভের ইন্টারন্যাশনাল রেনেসাঁ ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ওলেক্সান্ডার সুশকো ইউরোনিউজকে বলেছেন, পূর্ণমাত্রায় ইউক্রেন দখলের আশঙ্কা নেই। তিনি বলেন, ‘আমি ইউক্রেনের সম্পূর্ণ দখলে বিশ্বাস করি না। সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে এবং এজন্য মস্কোর যথেষ্ট সম্পদ নেই। ’
বিভিন্ন দেশের কাছে ইউক্রেন সামরিক সাহায্য চাইলেও কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বিশ্বের অন্যতম বড় অস্ত্র রপ্তানিকারক ছিল এই দেশটি। সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ থাকার সময়কালে ইউক্রেন সোভিয়েত অস্ত্রের ৩০ শতাংশই সরবরাহ করত একাই। সংখ্যার দিক থেকে দেশটির ৭৫০ টিরও বেশি কারখানায় ১০ লাখ শ্রমিক এ কাজে নিযুক্ত রয়েছেন এখনও। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাদের অনেক অস্ত্রই কালোবাজারে চলে যায়। যেসব অস্ত্রের অনেক বড় একটি অংশ এখন বিদ্রোহীদের হাতে। ২০১২ সালে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ছিল বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অস্ত্র রপ্তানিকারক দেশ। পাকিস্তান, চীন এবং রাশিয়া ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। তবে তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল-অস্ত্রের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরিতে সেরা হলেও সম্পূর্ণ অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম শিল্প তাদের ছিল না। তাছাড়া আরেকটি বড় সমস্য ছিল দুর্নীতি। ২০১০ সালের পর থেকে দুর্নীতির কারণে তাদের দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রায় ১ লাখ ৬৮ হাজার সামরিক কর্মী ছিলো, যাদের মধ্যে মাত্র ছয় হাজার জনের সামরিক প্রশিক্ষণ ছিলো। বাকিরা ছিল প্রশাসনের অকেজো অংশ।
যুদ্ধের মুখোমুখি ইউক্রেনের এই যখন অবস্থা তখন যুক্তরাষ্ট্র কঠোর শর্তের জালের মধ্যে রেখে কিয়েভে অস্ত্র পাঠানোর আশা দেয়। সেখানে বলা হয় যাদের অস্ত্র দেয়া হবে তাদের অবশ্যই সামরিক বাহিনীর সদস্য হতে হবে, সামরিক প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। এই শর্তের কারণে ইউক্রেনের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে আড়াই লাখ ঘোষণা করা হয়। তবে গত আট বছরে যুক্তরাষ্ট্র উইক্রেনে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এসব সামরিক সাহায্যের পাশাপাশি ন্যাটোর সক্রিয় সদস্য না হওয়া সত্বেও ন্যাটো ইউক্রেনে অনেক সামরিক প্রশিক্ষক পাঠিয়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের এগুলোই হচ্ছে বাস্তব পূঁজি।