মুক্তচিন্তা ডেস্ক : স্বামী যদি বেঁচে না থাকেন, তবে একজন মুসলিম স্ত্রী তার মৃত স্বামীর রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে নির্ধারিত অধিকার ভোগ করেন; স্বামীর অবর্তমানে স্ত্রীকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না। কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান বিয়ে করার সময় এমন অদ্ভুত এক চুক্তি করেছেন; যাতে লেখা রয়েছে, সম্পর্ক ছিন্ন হলে কিংবা খলিলুর রহমান মারা গেলে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা দাবি করতে পারবেন না স্ত্রী। ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি তিন পাতার ওই চুক্তিপত্র করার পাশাপাশি একইদিন সেটি চট্টগ্রাম সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি করা হয়। এই খবর প্রকাশ করেছে একুশে পত্রিকা।
ওই চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়, “১ম পক্ষ ও ২য় পক্ষ উভয়ে একে অপরের পরিচিত। সেই সূত্র ধরে তারা একে অপরকে ভালোবেসে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।” এখানে প্রথম পক্ষ হলেন কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমান (৭৭); দ্বিতীয় পক্ষ হলেন ৪৩ বছর বয়সী চট্টগ্রামের চন্দনাইশের একজন নারী। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সচিব অভীক ওসমান চৌধুরীর ভাতিজি। ছয়টি শর্ত সাপেক্ষে উক্ত ‘বৈবাহিক চুক্তি’ সম্পাদন করা হয়েছে বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়। প্রথম শর্ত- চুক্তিপত্রের মর্ম মতে ১ম পক্ষ ও ২য় পক্ষ রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা মূলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। দ্বিতীয় শর্ত- বিবাহের মোহরানা বাবদ ১০ লক্ষ টাকা ধার্য করা হয়। তন্মধ্যে কাবিননামা রেজিস্ট্রির দিন দেনমোহর বাবদ ১ম পক্ষ ৭ লক্ষ টাকা ২য় পক্ষকে নগদে পরিশোধ করবেন এবং বাকি ৩ লক্ষ টাকা ওয়ান ব্যাংক অক্সিজেন মোড় শাখায় পে-অর্ডার মূলে পরিশোধ করবেন। তৃতীয় শর্ত- বিবাহের পর উভয়পক্ষ স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দাম্পত্য জীবন পরিচালনা করবেন। চতুর্থ শর্ত- ১ম পক্ষ ২য় পক্ষকে স্ত্রী হিসেবে যাবতীয় ভরণপোষণ এবং স্ত্রী হিসেবে সামাজিক মর্যাদা প্রদান করবেন। চুক্তিপত্রের ৫ম শর্তে বলা হয়- ২য় পক্ষ বিবাহের বিষয় ১ম পক্ষের পরিবারের কোন সদস্যকে বা তার আত্মীয়-স্বজনদের সাথে শেয়ার করবেন না। ৬ষ্ঠ শর্তে বলা হয়- খোদা না করুক কখনো কোন সময় যদি পক্ষগণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হয় কিংবা ১ম পক্ষের মৃত্যু ঘটিলে ২য় পক্ষ ১ম পক্ষের নিকট হতে ১ম পক্ষের মালিকানাধীন যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দাবি দাওয়া করতে পারবেন না, করলে তা সর্বাদালতে সব ক্ষেত্রে অগ্রাহ্য হবে এবং অত্র চুক্তিপত্র বলবৎ থাকবে। উক্ত চুক্তিপত্রের ৫ম ও ৬ষ্ঠ শর্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বেশ কয়েকজন আইনজীবী জানিয়েছেন, চুক্তির এই দুটি শর্ত ‘void ab initio’ হিসেবে বিবেচ্য হবে। অর্থ্যাৎ শুরু থেকেই বাতিল।জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সদরের সাব-রেজিস্ট্রার মো. আশরাফউদ্দিন ভূঞা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘চুক্তিপত্র হচ্ছে দুইজনের সম্মতিতে একটি ডকুমেন্ট। কোর্ট যদি কখনও চায় তখন এটা তারা উপস্থাপন করতে পারে। আমরা শুধুই ফিস নিয়ে চুক্তিপত্র বা দলিল রেজিস্ট্রি করি। সেখানে যা লেখা হয়েছে তার দায়ভার যারা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছেন তাদের।’ চুক্তিপত্রের ৫ম ও ৬ষ্ঠ শর্তের বৈধতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএইচএম জিয়াউদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই ধরনের শর্তের আইনগত কোন ভিত্তি নেই। ইসলামী শরীয়ত মোতাবেক স্ত্রীর যা প্রাপ্য তা দিতে হবে। চুক্তি দিয়ে স্ত্রীকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।’ চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী একুশে পত্রিকাকে জানান, স্বামী মারা গেলে সন্তান না থাকলে স্ত্রী ১/৪ অংশ পাবেন। মৃত ব্যক্তির সন্তান যতই থাকুক ১/৮ অংশ পাবেন স্ত্রী। যদি একাধিক স্ত্রী থাকে তাহলে এক স্ত্রীর প্রাপ্য অংশ একাধিক স্ত্রীর মধ্যে সমান ভাগে ভাগ হবে। আইনের এসব বিধান উপেক্ষা করে উক্ত চুক্তিপত্রটি করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আরও আশ্বর্যের বিষয় এই চুক্তিপত্রটি তৈরি করে দিয়েছেন চট্টগ্রামের স্বনামধন্য আইনজীবী আহসানুল হক হেনা; যা চুক্তিপত্রে যা চুক্তিপত্রে উল্লেখ আছে। আহসানুল হক হেনার এত নাম-যশ-খ্যাতি যে, তিনিই উক্ত চুক্তিপত্রটি তৈরি করে দিয়েছেন, সেটি চট্টগ্রাম আদালতের একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিশ্বাসই করতে পারছেন না। আহসানুল হক হেনা ও কেডিএস মালিকের নাম উল্লেখ করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বিব্রতবোধ করেছেন। কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমানের অদ্ভুত চুক্তির বিয়ে সম্পর্কে জানতে প্রতিষ্ঠানটির আইন উপদেষ্টা আহসানুল হক হেনার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। চুক্তিপত্রটি আপনি তৈরি করে দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে প্রবীণ আইনজীবী আহসানুল হক হেনা বলেন, ‘হ্যাঁ, তো কী হয়েছে?’ এরপর চুক্তিপত্রের ৬ নাম্বার শর্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার কথা জানাতেই, এ বিষয়ে কথা বলবেন না জানিয়ে সংযোগ কেটে দেন আইনজীবী আহসানুল হক হেনা।এরপর চুক্তিপত্রের ৬ নাম্বার শর্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার কথা জানাতেই, এ বিষয়ে কথা বলবেন না জানিয়ে সংযোগ কেটে দেন আইনজীবী আহসানুল হক হেনা। এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে, কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. খলিলুর রহমানের ব্যক্তিগত নাম্বার প্রদান করতে প্রতিষ্ঠানটিকে গত ৫ এপ্রিল ইমেইল করা হয় একুশে পত্রিকার পক্ষ থেকে; কিন্তু এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।