চৈত্র মাসের খড়খড়া রোদে বাড়ির উঠান ফেটে উঠছে। মাটির নিচের পানি আরো গভীরে চলে যাচ্ছে। চতুর্ভুজ আকৃতির আমাদের উঠানের পুব পাশেই টিউবওয়েলটি বসানো। গত কয়েকযুগ ধরে এই টিউবওয়েল থেকে আমরা সবাই পানি পান করি। শুধু আমরাই পান করি না। আশেপাশের সকল পরিবারই পানি নেয়। খুব মিঠা পানি। কয়েকদিন ধরে টিউবওয়েল থেকে মিঠাপানি আর পড়ে না। কেউ পানি নিতেও আসে না।
কড়া রোদে টিউবওয়েলের চারপাশে শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। বৃষ্টিও নেই। এখন টিউবওয়েলটি দেখে বোঝার উপায় নেই, রোজ কয়েক হাজার লিটার পানি এই টিউবওয়েল থেকে তোলা হয়।
কয়েকদিন দিন ধরে চাকুরির পরীক্ষা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম। টিউবওয়েলের দিকে নজর দিতে পারিনি। আগে তো নষ্ট হলেই মিস্ত্রী ডেকে সারিয়ে নিতাম। কিন্তু এখন আর মিস্ত্রী আনতে পারি না। বড্ড খরচ লাগে। তাই নিজেই যন্ত্রপাতি কিনে এনেছি। টিউবওয়েলটি নষ্ট হলে নিজ হাতে দীর্ঘ সময় নিয়ে সারিয়ে তুলি।
টিউবওয়েল সারাতে একটি বড় একটি ছোট সাইজের রেঞ্চ কিনেছি। তা দিয়ে টিউবওয়েলের লোহার নাটগুলো খুলে দেখি—কখনো ভেতরের ওয়াসার নষ্ট হয়ে গেছে। কখনো বা দেখি বাকেট ছিঁড়ে গেছে। কখনো কখনো দেখা যায় পুরো ভেতরের প্লাঞ্জার সেটটিই নষ্ট হয়ে গেছে। জং পড়ে অকেজো হয়ে আছে। এসব আমি একা একাই সারিয়ে ফেলি।
যখন আমাদের টিউবওয়েলটি সচল থাকে—তখন এত এত মানুষ এটাকে ব্যবহার করে যে দ্রুতই নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কখনোই কেউ নষ্ট হওয়ার পরে খোঁজ নিতে আসে না। যখন সারানোর পরে বাড়িতে টিউবওয়েলে চাপের শব্দ পাওয়া যায়, তখন আবার মানুষের ভিড় পড়ে যায়।
যদিও এখন সব বাড়িতেই টিউবওয়েল বসানো হয়েছে। তবুও বেশি মিঠা পানির জন্য অনেকেই আমাদের বাড়ির টিউবওয়েলেই পানি নিতে আসে। আমরা কাউকেই না করতে পারি না।
সেদিন দুপুরের ভ্যাপসা গরমে আমি টিউবওয়েলটি একান্ত মনে সারাতে থাকি। এমন সময় মা বেশ ভারী গলায় আমাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকেন—‘সারাদিন মানুষে টিউবওয়েলটা চাপতে থাকে। এত চাপতে থাকলে তো নষ্ট হবেই।’—মায়ের কথায় আমি কোন সাড়া দেই না। তবুও মা একা একাই বলতে থাকেন—‘সবাই গায়ের সব জোর দিয়ে টিউবওয়েলটা চেপে নষ্ট করে চলে যায়। আর কোন খবর থাকে না। এখন আমার পোলার যত কষ্ট। কল সারতে সারতেই পোলার জীবনটা ফালাফালা হয়ে গেল।’
‘চুপ করো, মা। মানুষ তো একটু পানি নেয়। পানি খাওয়ানো তো বড় পুণ্যের কাজ। কতজন মানুষের ভাগ্যে এই সুযোগ আসে। তুমি এখন চুপ করো।’
মা থামেন না। বকবক করে বলতেই থাকেন—‘আমার পোলায় একটা চাকরি পাইলে কদিন পর পরেই টিউবওয়েলটাকে সারাতে হইত না। বাড়ি ছেড়ে দূরে গিয়ে থাকত। কবে যে পোলায় একটা চাকুরি পাইবে আর আমাদের দুঃখ যাইবে।’
মায়ের কথা শুনি আর ভাবি—টিউবওয়েলের কলকব্জা নষ্ট হলে সারিয়ে আবার সচল করা যায়। কিন্তু দেশের কলকব্জা টিউবওয়েলের মতন সারিয়ে তোলা যাচ্ছে না। সে তো অবিরাম নষ্ট হচ্ছেই। তবুও আমরা একজন জাদুকরের অপেক্ষায় আছি। সে এসে দেশটাকে টিউবওয়েলের মতনই একদিন সারিয়ে তুলবে।