Home শিল্প-সাহিত্য হারুকি মুরাকামির ‘শেহেরজাদ’

হারুকি মুরাকামির ‘শেহেরজাদ’

অনুবাদ : সাজিদ উল হক আবির

Mukto Chinta
০ comment ৬৬ views

প্রতিবার সংগমে লিপ্ত হবার পর হাবারাকে মেয়েটি এক অদ্ভুত, কিন্তু টানটান উত্তেজনায় ভরপুর গল্প বলত, সহস্র আরব্যরজনির গল্পের রানি শেহেরজাদের মতো। যদিও বাদশাহ হারুন অর রশিদের মতো হাবারার পরদিন সকালে তার মাথা কেটে ফেলার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। (পরদিন সকাল পর্যন্ত তার এমনিতেও হাবারার সঙ্গে থাকা হতো না) সে নারী হাবারাকে গল্প বলত, হয়তো এমনিতেই; হয়তো যৌনসংগমের মতো খুব ঘনিষ্ঠ এবং উষ্ণ একটি শারীরিক ক্রিয়ার পর মেয়েটি এমনি এমনিই কিছুটা সময় বিছানায় কুণ্ডলী পাকিয়ে হাবারার শরীর ঘেঁষে শুয়ে গল্প করতে ভালোবাসত। আবার হাবারাকে কিছুটা আনন্দের জোগান দেয়াও তার এই গল্প বলার অনুপ্রেরণা হতে পারে, কারণ হাবারার দিনের পর দিন এই এক ফ্ল্যাটের মধ্যেই আটকা পড়ে কালাতিপাত করা লাগে।

এই গল্প বলার সূত্রেই হাবারা মেয়েটার নাম দিয়েছিল ‘শেহেরজাদ’। যদিও সে কখনো তাকে সামনাসামনি শেহেরজাদ বলে ডাকত না, কিন্তু তার একটি ছোট ডায়রি ছিল যার পাতায় মেয়েটিকে হাবারা সবসময় ‘শেহেরজাদ’ নামে উল্লেখ করত। “শেহেরজাদ এসেছিল আজকে,” এভাবে সে লিখত তার বলপয়েন্টের কলমে। তারপর হাবারা সেদিনের ঘটনাবলি সোজাসাপটা হাতের লেখায়, কিন্তু নানাবিধ প্রতীক এবং সংকেত ব্যবহার করে খুব সংক্ষেপে টুকে রাখত। কারও পক্ষে সেটা পড়ে অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব ছিল না।

এদিকে ওর গল্প শুনে এটা নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় ছিল না যে ওগুলো আসলেই সত্যি, নাকি ওর মনগড়া; নাকি আংশিক সত্যি আংশিক মনগড়া। কেননা সত্যমিথ্যা যাচাই করার কোনো উপায় ছিল না হাবারার। বাস্তবতা আর অনুমানপ্রবণতা, পর্যবেক্ষণজনিত সত্য আর কাল্পনিকতা—এ সবকিছুই দারুণভাবে মিলেমিশে থাকত তার বর্ণনায়। বাচ্চারা যেমন গল্পের সত্যমিথ্যা নিয়ে প্রশ্ন করার বদলে কেবল মনোযোগ দিয়ে গল্প শোনে, হাবারা ঠিক সে কায়দায় শুয়ে শুয়ে গল্প শুনত ওর। সত্য হোক, মিথ্যা হোক, অথবা এ দুয়ের সংমিশ্রণ হোক, প্রকৃতপক্ষে হাবারার তাতে কিছু যায় আসে না।

ঘটনা যাই হোক, শেহেরজাদের ছিল গল্প বলার জাদুকরী ক্ষমতা। সে যা-ই বলত, তা এসে সোজা ঘাই মারত হাবারার হৃদয়ে। দৈনন্দিন জীবনের একদম সাধারণ একটা ঘটনাকেও অসাধারণ করে উপস্থাপন করার শক্তি ছিল তার। কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, বাক্য বা অনুচ্ছেদের মাঝে বিরতি, গল্পের টানটান গতি—সবকিছুই ছিল নিখুঁত। একদম শুরুতেই সে তার শ্রোতার মনোযোগ হাতের মুঠোয় নিয়ে নিত, আগ্রহ বাড়িয়ে তুলত ক্রমশ, বাধ্য করত তাকে ভাবতে, পরবর্তী অংশ অনুমান করতে। পরিশেষে থাকত গল্পের আকাক্সিক্ষত পরিসমাপ্তি। তার গল্পে ডুবে গিয়ে হাবারা যে বাস্তবতায় আটক, তাকে ভুলে থাকতে পারত সাময়িকভাবে। একটা কালো বোর্ডকে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে সম্পূর্ণ মুছে ফেলার মতো করে গল্পগুলো হাবারার মন থেকে সব দুশ্চিন্তা এবং কষ্টকর স্মৃতি মুছে ফেলত। এর চেয়ে বেশি চাওয়ার কী থাকে? জীবনের এ পর্যায়ে দুশ্চিন্তা আর দুঃখের স্মৃতিগুলো ভুলে থাকার চেয়ে বেশি কিছু চায় না হাবারা।

শেহেরজাদের বয়স পঁয়ত্রিশ। বয়সের হিসেবে সে হাবারার চেয়ে চার বছরের বড়। পুরোদস্তুর গৃহিণী সে, নার্সারি স্কুলে যায় এমন দুটো বাচ্চা আছে তার (যদিও একসময় সে নার্সিংয়ের ওপরে একটা ডিগ্রি নিয়েছিল এবং সময়ে সময়ে এখনও সে এই কাজের জন্য ডাক পায় এখান-ওখান থেকে)। তার স্বামী একটা কোম্পানির সাধারণ কর্মচারী। শেহেরজাদের বাসা, গাড়িতে করে এখান থেকে ঠিক কুড়ি মিনিটের দূরত্বে। এই ছিল তার সব (বা, প্রায় সব) ব্যক্তিগত তথ্য যা শেহেরজাদ তাকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দিয়েছিল। হাবারার পক্ষে এ সমস্ত তথ্য যাচাই করে দেখার উপায় বা প্রয়োজন—কোনোটাই ছিল না। শেহেরজাদ অবশ্য কখনোই হাবারাকে তার নাম জানায়নি। “নাম জেনে কী হবে, তাই না?” প্রশ্ন করত সে। তার কথায় যুক্তি ছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনা এভাবেই ঘটতে থাকে, যেভাবে এখন ঘটছে—সে ‘শেহেরজাদ’ হয়েই থাকুক হাবারার কাছে। কোনো সমস্যা নেই।

সে অবশ্য হাবারাকেও কখনো তার নাম ধরে ডাকত না, যদিও হাবারার নাম তার জানা ছিল। সে খুব সতর্কতার সঙ্গে প্রতিবার হাবারার নাম উচ্চারণ এড়িয়ে যেত, যেন তার ঠোঁটের ফাঁক গলে হাবারার নাম বেরিয়ে যাওয়াটা অসমীচীন, অথবা হাবারার জন্য দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হবে।

বাহ্যিকভাবে আরব্যরজনির রূপসী রানি শেহেরজাদের সঙ্গে হাবারার ‘শেহেরজাদ’-এর কোনো মিলই ছিল না। সে ছিল মফস্বল শহরের মাঝবয়সী এক গৃহিণী, যার শরীর মোটামুটি ছেড়ে দিয়েছিল এতদিনে (তার শরীরের কোনো অংশই আর তাদের পূর্বের ধারালো আকৃতিতে ছিল না)। থুতনির নিচে প্রায়ই গলকম্বল উঁকি দিত। চোখের কোণায়, প্রসাধনীর আড়াল থেকে বলিরেখাও উঁকি মারত মাঝেসাঝে। তার চুলের স্টাইল, চেহারায় ব্যবহৃত প্রসাধনী, পোশাক-পরিচ্ছদ—কোনো কিছুই খুব সেকেলে না হলেও পোশাক বা প্রসাধনীর ব্যবহারে তাকে লেটার মার্কস দেয়া যায় না। একই সঙ্গে তার চেহারাছবি, তার শরীরের গড়ন—অনাকর্ষণীয় না হলেও বিগত তারুণ্যে হারিয়ে ফেলা সেই জৌলুশও বিদ্যমান ছিল না যে এক নজরেই সে কাউকে ঘায়েল করে ফেলবে। এ জন্যে রাস্তায় বা লিফটের মাঝে তাকে আর আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য এই শেহেরজাদকে দেখে অনুমান করা যায় যে দশটি বছর আগে সে নিশ্চয়ই খুব প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয় এক তরুণী ছিল। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে কয়েক জোড়া চোখ হয়তো আপনাতেই তার অনুসরণে ঘুরে যেত। যাপিত জীবনের কোনো এক পর্যায়ে এসে তার সে অংশের যবনিকা টানা হয়ে গেছে। সেই পর্দা আর সহজে কখনো উঠবে বলে মনে হয় না।

হাবারার বাড়িতে শেহেরজাদের আগমন ঘটে সপ্তাহে দুবার। এই দুটো দিন পূর্ব নির্ধারিত না হলেও সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সে কখনোই আসে না। বোঝা যায়, ঐ সময়টুকু সে তার পরিবারের সঙ্গে ব্যয় করে। আগমনের ঠিক এক ঘণ্টা আগে সে হাবারাকে ফোন করে। হাবারার গৃহস্থালি কাজের জন্য প্রয়োজনীয় আনাজপাতি কিনে সে তার নীল রঙের ছোটখাটো মাজদা হ্যাচব্যাক গাড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসে। তার গাড়িটা বেশ পুরনো মডেলের। পেছনের বাম্পারে বড়সড় একটা ছিদ্রও আছে। চাকায় ময়লা জমে একদম কালো হয়ে গিয়েছে সেটা। হাবারার বাড়ির সামনের কার-পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে রেখে মালামালে হাত বোঝাই করে সে হাবারার ফ্ল্যাটের দরজায় বেল বাজায়। দরজার ছিদ্র দিয়ে মেয়েটার চেহারা দেখার পর নিশ্চিন্ত হাবারা দরজার লক খোলে, চেইন নামিয়ে দিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে আসে।

ঘরে প্রবেশ করে সে সোজা রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে। সঙ্গে করে বয়ে আনা সমস্ত শাকসবজি আনাজপাতি রেফ্রিজারেটরের ভেতরে বা যার যার জায়গামতো সাজিয়ে রাখে। তারপর পরেরবার আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসা লাগবে এমন জিনিসপত্রের একটি তালিকা তৈরি করে। টু শব্দটি না করে একদম পাকা গিন্নীর মতো অতি অল্প নড়নচড়নে ও হাতেগোনা পদক্ষেপে সে এ সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে।

কাজগুলো শেষ হওয়া মাত্রই তারা দুজন বিনাবাক্যে, যেন এক অদৃশ্য তড়িৎ প্রবাহের অধীনস্থ অবস্থায় বেডরুমে চলে যায়। দ্রুতগতিতে জামাকাপড় খুলে রেখে শেহেরজাদ নিঃশব্দে হাবার সঙ্গে গিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মিলনের মুহূর্তেও সে কোনো কথা বলে না, দেখেশুনে মনে হয় যেন এই সংগমও তার ওপর আরোপিত অ্যাসাইনমেন্টগুলোর একটি। তার মাসিকের সময়গুলোতে সে হাত ব্যবহার করে হাবারার কাজটা করে দিত। শেহেরজাদের দ্রুতগতিতে এবং নিখুঁতভাবে কর্ম সম্পাদনের দক্ষতা দেখে হাবারার এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না যে নার্সিংয়ের ওপর তার পেশাদারি সার্টিফিকেট কোর্স করা আছে। সে একজন লাইসেন্সধারী নার্স।

সেক্সের পর, যেমনটা আগেই বললাম, তারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করত। আরও নিখুঁতভাবে বলতে গেলে কথা যা বলার তা শেহেরজাদই বলত, আর হাবারা মূলত শুনত। শুনতে শুনতেই কখনো সে হয়তো দু-একটা শব্দ যোগ করত শেহেরজাদের বক্তব্যের সঙ্গে বা একটি সম্পূরক প্রশ্ন করত। ঘড়ির কাঁটা বিকেল সাড়ে চারটার দাগ স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি গল্প থামিয়ে দিয়ে উঠে পড়ত (অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, প্রতিবারই তার গল্প ততক্ষণে বেশ চিত্তাকর্ষক এক জায়গায় এসে পৌঁছে যেত), দ্রুতগতিতে সে তখন কাপড়চোপড় পরে বেরিয়ে পড়ত হাবারার অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে। বাড়ি ফিরে তাকে রাতের খাবার রান্না করতে হবে, বলত সে।

হাবারা তার পেছন পেছন যেত সদর দরজা পর্যন্ত। সে বেরিয়ে গেলে দরজার ছিটকিনি তুলে দিয়ে হাবারা জানালার পর্দার ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখত শেহেরজাদের পুরনো ছোট নীল রঙের গাড়িটার পার্কিং স্পেস থেকে ঘুরে প্রধান সড়কে উঠে এসে সেখান থেকে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। ছটা বাজলে সে খুব সাদাসিধে গোছের রাতের খাবার রান্না করে একা একাই খাওয়া দাওয়ার পাট চুকাত। একসময় সে পেশাদার বাবুর্চি হিসেবে কাজ করত, তাই এ সামান্য রান্নার আয়োজন তার জন্য মোটেও মুশকিল কিছু ছিল না। রাতের খাবারের সঙ্গে হাবারা প্যারিয়ের নামক এক পানীয় পান করত বরাবর (ওঠা ঠিক মদ নয়, আর হাবারা কখনোই মদ্যপান করত না), তারপর কোনো এক ডিভিডি ছেড়ে বা বই পড়তে পড়তে কফির মগে চুমুক দিত। হাবারার পছন্দ ছিল মোটা মোটা বইগুলো, বিশেষ করে যে বইয়ের অর্থ বুঝবার জন্য একই পাতা বারবার বারবার করে পড়া লাগে। মোটাদাগে এই ছিল তার নিয়মিত রুটিন। কথা বলার মতো তার কেউ ছিল না, ফোন করবারও প্রয়োজন পড়ত না। রুমে কোনো কম্পিউটার না থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহার করার সুযোগও ছিল না। তার ফ্ল্যাটে কখনো সংবাদপত্র আসত না, আর টিভি দেখায়ও তার কোনো আগ্রহ ছিল না (এর অবশ্য বিশেষ কারণ ছিল)। আর বলাই বাহুল্য, সে ফ্ল্যাট ছেড়ে বাইরে বেরুতে পারত না। যদি শেহেরজাদ একবার আসা বন্ধ করে দেয় তার ফ্ল্যাটে, বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সমস্ত সংযোগ বন্ধ হয়ে সে সম্পূর্ণ একাকী হয়ে যাবে।

হাবারা অবশ্য শেহেরজাদের হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে খুব একটা চিন্তাভাবনা করে না। যদি কখনো এটা ঘটে, তাহলে ব্যাপারটা বেশ কষ্টকর হয়ে যাবে তার জন্য, সে ভাবে; কিন্তু তখনেরটা তখনই দেখা যাবে। আমি কোনো মরুভূমিতে পথ হারানো পথিক নই, একেবারেই না, হাবারা ভাবত। আমি নিজেই এক আদ্যপান্ত মরুভূমি। হাবারার এই বক্তব্য যদি সে সত্যসত্যই বিশ্বাস করে থাকে, তাহলে আসলেই তার জন্য দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না। এটা ঠিক যে সে বরাবরই একাকী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। একাকিত্বের মাঝে তার স্নায়ু শীতল এক প্রশান্তিতে ডুবে থাকার স্বাদ খুঁজে পায়। কিন্তু সেক্সের পর বিছানায় শুয়ে শুয়ে শেহেরজাদের গল্প শুনতে না পারার চিন্তা তাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে, শেহেরজাদের অসম্পূর্ণ গল্পের পরবর্তী অংশ শোনার জন্য তার মধ্যে এক ব্যাকুলতা কাজ করে।

এই বাড়িতে এসে ওঠা মাত্রই হাবারা দাড়ি বড় করা শুরু করেছে। তার দাড়ি গড়পড়তা পুরুষদের চেয়ে এমনিতেই বেশ ঘন ছিল। হাবারার চেহারাছবিতে একটা আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, অমন কোনো সুপ্ত বাসনা ছিল না তার। তার দাড়ি বড় করার মূল উদ্দেশ্য ছিল তার হাতের অঢেল সময় কাটানোর একটা উপায় বের করা। একবার বড় হয়ে যাওয়ার পর দাড়ি খিলাল করে, অর্থাৎ দাড়ির ভেতর আঙুল চালিয়ে চালিয়ে, জুলফি বা গোঁফে তা দিয়ে সময় কাটানো যাবে, এই ছিল তার পরিকল্পনা। আবার বেশি বড় হয়ে গেলে কাঁচি বা ক্ষুরের যথাযথ প্রয়োগে ঘটা করে দাড়িগোঁফ সাইজ করা যাবে। এভাবেও সময় নষ্ট করা যেতে পারে। ঘন দাড়িগোঁফে ছাওয়া মুখ দিনের পর দিন আয়নায় একই রকম চেহারার প্রতিবিম্ব দেখার ক্লান্তি থেকেও মানুষকে মুক্তি দেয়।

“আগের জীবনে আমি ল্যাম্প্রে প্রজাতির ইল মাছ ছিলাম,” বিছানায় হাবারার পাশে গুটিশুটি পাকিয়ে শুয়ে শেহেরজাদ বলেছিল একদিন। উত্তর মেরু পৃথিবীর একদম উত্তরে—এই অলঙ্ঘনীয় ভৌগোলিক সত্যের মতোই এক সহজসরল স্বীকারওক্তির সত্যতা ছিল শেহেরজাদের উচ্চারিত বাক্যটিতে। এদিকে হাবারার ‘ল্যাম্প্রে’ নামে যে এক প্রজাতির ইল মাছ দুনিয়ায় পাওয়া যায়—এ সংক্রান্ত কোনো ধারলাই ছিল না হাবারার, ফলে ওটা দেখতে কেমন—তা ছিল পুরোপুরি তার হিসাবের বাইরে। কাজেই শেহেরজাদের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনো মতামত রাখা তার পক্ষে সম্ভব হলো না।

“তুমি জানো, ল্যাম্প্রের প্রধান খাবার হলো ট্রাউট মাছ?” শেহেরজাদ জিজ্ঞেস করল।

হাবারা জানত না। ল্যাম্প্রের নামের মতোই, ল্যাম্প্রের খাদ্যাভ্যাসও ছিল তার জন্য একদম নতুন একটা ব্যাপার।

“ল্যাম্প্রের কিন্তু কোনো চোয়াল নেই। এটাই ইল মাছের অন্যান্য প্রকরণ থেকে ওদেরকে আলাদা করে।”

“হ্যাঁ? ইল মাছের চোয়াল থাকে?”

“সে কী রে বাবা! কোনোদিন ভালো করে একটা ইল মাছ তুমি খেয়াল করে দেখোনি?” শেহেরজাদ অবাক হয়ে বলে।

“মানে, আমি কালেভদ্রে হয়তো ইল মাছ রেঁধে খাই। তাই বলে ইলের চোয়াল আছে কি নেই—এটা নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ হয়নি আমার কখনো।”

“আচ্ছা, সময়সুযোগ মতো একবার পরীক্ষা করে দেখো। কোনো ইল মাছওয়ালা অ্যাকুরিয়াম বা এমন কোনো জলাধার পেলে খেয়াল কোরও। সাধারণ যেসব ইল মাছ, ওদের চোয়ালের সঙ্গে সঙ্গে দাঁতও থাকে। কিন্তু ল্যাম্প্রের থাকে কেবল চুষনির মতো একটা ছিদ্র। এটা দিয়ে নদী বা লেকের নিচে পাথরের সঙ্গে ওরা নিজেদের আটকে ফেলে ভাসিয়ে রাখে। তারপর তারা স্রেফ ভেসে থেকে ডানে-বামে দোলে, পানির নিচের জলজ লতাগুল্মের মতো।

হাবারা গভীর কোনো জলাশয়ের নিচে লতাগুল্মের মতো দোল খেতে থাকা একগুচ্ছ ল্যাম্প্রেকে কল্পনা করল মনে মনে। দৃশ্যটা বাস্তবতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন মনে হল, যদিও বাস্তবতা, হাবারা জানে, প্রায়ই অবিশ্বাস্য রকমের অবাস্তব হয়।

“গভীর পানির নিচের গাছপালার মাঝে লুকিয়ে, নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে করতে ল্যাম্প্রেরা বেঁচে থাকে। তারপর, যখনই একটা ট্রাউট ওর আশপাশ দিয়ে যায়, বিদ্যুদ্গতিতে সেই ল্যাম্প্রে ওর চুষনি দিয়ে আটকে ফেলে ওকে। সেই চুষনির মধ্যে আবার দাঁতাল জিহ্বা থাকে একটা। ওটা সামনে পিছে ঘষে ঘষে ট্রাউটের ভুঁড়ি ফাঁসিয়ে দেয়। তারপর সেই চুষনি দিয়ে সজোরে চুষে চুষে ভেতরের সমস্ত মাংস গিলে ফেলে সে, একটু একটু করে।”

“আমি যেন কখনো ল্যাম্প্রের সামনে না পড়ি, কখনো যেন আমাকে দুর্ভাগা ট্রাউটের নসিব বরণ করতে না হয়,” হাবারা বলে।

“রোমানদের আমলে তারা পুকুরেই ল্যাম্প্রের চাষ করত। তাদের যেসব দাসেরা আদেশ নির্দেশ অমান্য করত, তাদেরকে রোমানরা ক্ষুধার্ত ল্যাম্প্রেতে ভর্তি পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিলে ল্যাম্প্রেরা সে মানুষগুলোকে জ্যান্ত খেয়ে ফেলত।”

হাবারা ভেবে দেখল, ল্যাম্প্রের পেটে যাওয়া কোনো রোমান দাসের পরিণতি বরণ করার আগ্রহও নেই তার। অবশ্য দাসত্ব এমনটা একটা ব্যাপার, দিনশেষে ক্ষুধার্ত ইল মাছের পেটে ঢোকা ছাড়াও যেটা খারাপ।

“আমি যখন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রী, তখন পুরো ক্লাসের সঙ্গে বড় বড় মাছ ভর্তি অ্যাকুরিয়াম দেখতে গিয়ে আমি প্রথম ল্যাম্প্রে—ইলের সঙ্গে পরিচিত হই,” শেহেরজাদ বলে। “ওদের জীবনযাপনের ধরন সম্পর্কে জানা মাত্রই আমি টের পেয়েছিলাম, আগের জন্মে এক ল্যাম্প্রে ছিলাম আমি। নদীর গহিনে পাথরের সঙ্গে লেগে লতাগুল্মের মতো দুলে দুলে ভাসতে থাকা, তারপর আশপাশ দিয়ে পেট মোটা এক ট্রাউট মাছ ভেসে যাওয়া মাত্রই আচমকা আক্রমণ করে ওর ভুঁড়ির দফারফা বানিয়ে ফেলা, এই সব স্মৃতিপলকের মাঝে আমার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে গেল তখন তখনই।”

“কাঁচা ট্রাউট খাবার স্মৃতি মনে আছে তোমার?”

“নাহ, মাছ খেতে কেমন লেগেছিল, সেটা মনে নেই।”

“বাঁচলাম বাবা,” হাবারা বলে। “কিন্তু পূর্বজন্মের স্রেফ এতটুকু স্মৃতিই তোমার মনে আছে কেবল? ল্যাম্প্রে হয়ে নদীর গহিনে ভাসতে থাকা?”

“পূর্বজন্মের স্মৃতি ফিরে পাওয়া মুখের কথা নয়,” শেহেরজাদ বলে। “নসিব ভালো থাকলে হঠাৎ হঠাৎ কিছু স্মৃতি বিদ্যুদ্গতিতে মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে, আবার চলে যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে খুব সরু একটা ছিদ্র দিয়ে দেয়ালের ওপারে কী ঘটছে সেটা দেখবার চেষ্টা করার মতন। ওপাশে যা আছে, তার খুব অল্পই দেখা যায়। তোমার পূর্বজন্মের কোনো স্মৃতি আছে?”

“একদম না,” হাবারা উত্তর দেয়। সত্যি বলতে, পূর্বজন্ম বলে যদি কিছু থেকেও থাকে, তার সেটা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। বর্তমান জীবনের হ্যাপা সামলেই সে কূল পাচ্ছে না।

“যা হোক, নদীর একদম নিচে পানি অনেক স্বচ্ছ। আমার মুখ নিচে, কারণ আমি একটা পাথরকে চুষে ধরে রেখেছি, আর আমার বাকি শরীর ওপরের দিকে। আমার আশপাশ দিয়ে মাছেরা ভেসে যাচ্ছে। বিশাল বড় এক কাছিম একবার দেখেছিলাম, কালো রঙের, স্টার ওয়ার্স মুভির সেই শয়তান স্পেসশিপগুলোর মতো সাঁতরে বেড়াচ্ছে আমার পাশে। ওপর থেকে লম্বা ঠোঁটের সাদা পাখিগুলো গুণ্ডাদের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ত জলাশয়ের মাছেদের ওপর। পানির নিচ থেকে তাদের দেখতে নীল আকাশে সাঁতরে বেড়ানো সাদা মেঘের মতোই লাগত। অবশ্য আমার মতো ল্যাম্প্রেদের এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। পানির একদম নিচে গাছপালার সঙ্গে মিশে থাকার কারণে ওরা কখনো আমাদের নাগাল পেত না।”

“এসব স্মৃতি এখনও তোমার মনে আছে?”

“দিনের আলোর মতো পরিষ্কার,” শেহেরজাদ বলে। “পানির নিচের আলো, স্রোতের প্রবাহ—সবকিছু। প্রায়ই মনে মনে আমি সেই সময়ে ফেরত যাই।”

“পানির নিচে?”

“হ্যাঁ।”

“মনে মনে?”

“একদম ঠিক।”

“ল্যাম্প্রেরা কী চিন্তা করে, মনে মনে?”

“ল্যাম্প্রেরা আসলে ল্যাম্প্রেদের মতো করেই চিন্তা করে। ল্যাম্প্রে সংক্রান্ত বিষয়আশয়ে, ল্যাম্প্রেদের প্রাসঙ্গিকতায়। ওগুলো মানুষের ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। পানির জগতের বিষয়াদি। এটা অনেকটা নিজের মাতৃগর্ভের স্মৃতির মতো। মায়ের পেটের মধ্যেও আমাদের মস্তিষ্কে নানা চিন্তা ঘুরপাক খেত, কিন্তু সে চিন্তা কি এখন আমরা এই পৃথিবীর ভাষায় প্রকাশ করতে পারি?”

“এক সেকেন্ড! তোমার মাতৃগর্ভের স্মৃতি মনে আছে?”

“অবশ্যই,” নিজের মাথা খানিকটা উঠিয়ে শেহেরজাদ হাবারার বুকের ওপর কিছু একটা দেখল। “কেন, তোমার মনে নেই?”

“না,” হাবারা বলল, তার মনে নেই এমন কিছু।

“তাহলে আমি তোমাকে বলব কখনো কখনো, মাতৃগর্ভের গল্প।”

“শেহেরজাদ, ল্যাম্প্রে, আগের জনম” হাবারার ডায়েরির পাতায় এই ছিল শিরোনাম, সেদিন। কেউ এই শিরোনাম পড়ে আদৌ কিছু বুঝতে পারবে বলে হাবারার মনে হলো না।

শেহেরজাদের সঙ্গে হাবারার পরিচয় চার মাস আগে। হাবারাকে সে সময়ই টোকিওর উত্তরপার্শ্বের এই প্রাদেশিক শহরে এনে রাখা হয়। শেহেরজাদকে তখন তার ‘সহায়ক মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। যেহেতু হাবারার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না, তাই শেহেরজাদ তার খাবার কিনে দেয়া থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় সমস্ত জিনিস সরবরাহ করার দায়িত্বভার গ্রহণ করে। সে হাবারার পছন্দমতো বই, সাময়িকী এবং সিডিও সরবরাহ করত, প্রায়ই হাবারার জন্যে ডিভিডিও নিয়ে আসত, যদিও ওর ডিভিডির চয়েজ হাবারার পছন্দ হতো না।

এর ঠিক এক সপ্তাহের মাথায়, যেন দৈব নির্ধারিত পরবর্তী ধাপ হিসেবেই শেহেরজাদ তার সঙ্গে বিছানায় যায়। হাবারা এই ফ্ল্যাটে এসেই খেয়াল করেছিল, বিছানার পাশের ছোট্ট টেবিলটাতে কনডমের প্যাকেট রাখা। হাবারা ধরে নিয়েছিল, সেক্স শেহেরজাদের ওপর আরোপিত দায়িত্বগুলোরই একটি, অথবা, তাদের ভাষায়—‘সহায়ক কার্যক্রম’। নাম অথবা উদ্দেশ্য যাই হোক, হাবারা ওর সঙ্গে বিছানায় যেতে দ্বিধা করেনি মোটেই, স্রোতের টানে ভেসে যাওয়াটাই তার কাছে স্বাভাবিক লেগেছে। টুকটাক কাজ সেরে সোজাসুজি বিছানায় চলে গিয়ে তারা সংগমে লিপ্ত হয়, আর শেহেরজাদ চলে যাওয়ার পর হাবারা পুরো ব্যাপারটা ঘিরে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর চেষ্টায় রত অবস্থায় চিন্তায় ডুবে থাকে।

গভীর ভালোবাসায় ডুবে তারা সংগমে লিপ্ত হতো ব্যাপারটা অবশ্যই এমন ছিল না; আবার সেটা পুরোপুরি পয়সা দিয়ে সেক্স করার মতোও ছিল না। প্রাথমিকভাবে এটা শেহেরজাদের কাজের একটা অংশ হিসেবে (বা, সরাসরি কাজের অংশ না হলেও শেহেরজাদকে নিয়োগ দিয়েছে যারা, তাদের দিক থেকে উৎসাহ দেয়া হতো শেহেরজাদকে এ কাজ করার জন্য) শুরু হলেও, একপর্যায়ে গিয়ে শেহেরজাদ নিজেও হাবারার সঙ্গে সংগমের ব্যাপারটা একটু একটু করে উপভোগ করা শুরু করে। ওর শরীরী ভাষার ছোট ছোট পরিবর্তনের ফলে হাবারা ব্যাপারটা বুঝতে পারত। শেহেরজাদের এই পরিবর্তন হাবারাকেও ভেতরে ভেতরে খুশি করে তুলেছিল। দিন শেষে হাবারা তো খাঁচায় আটকে রাখা কোনো জন্তুবিশেষ নয়, সে সাধারণ্যের মতোই নানাবিধ আবেগ-অনুভূতিসম্পন্ন একজন মানুষ। যৌনক্রিয়ায় লিপ্ত হয়ে বীর্যপাতের মাধ্যমে অর্জিত শারীরিক প্রশান্তি একটা দরকারি জিনিস, কিন্তু কোনো রকম মানসিক সংযোগ ছাড়া সংগমে লিপ্ত হয়ে ক্রমাগত বীর্যপাত করতে থাকাটা একজন চিন্তাশীল, ভাবুক প্রকৃতির মানুষকে পূর্ণ পরিতৃপ্তি দিতে পারে না। হাবারা জানে এসব, কিন্তু তাদের এই যৌনক্রিয়াকে শেহেরজাদ কতটুকু তার চাকরির অংশ হিসেবে দেখে, আর কতটুকুই বা তার ব্যক্তিগত অংশগ্রহণ থাকে হাবারার পক্ষে তা আলাদা করা সম্ভব হয় না।

শুধু যৌনতার বিষয়টা নয়, হাবারার অন্যান্য যে সমস্ত কাজেও শেহেরজাদ সূক্ষ্ম ও সুচারুরূপে সাহায্য করে, তারই বা কতটুকু হাবারার প্রতি মায়ার তাড়নায় (যদি এই ক্ষেত্রে মায়া শব্দটা ব্যবহার করা যায় আর কি), আর কতটুকু তার ওপর আরোপিত দায়িত্বের প্রেষণে? হাবারার পক্ষে প্রায়ই শেহেরজাদের উদ্দেশ্য এবং অনুভূতির পাঠ অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। দু-একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা স্পষ্ট করা যাক। শেহেরজাদ প্রায়ই মধ্যত্রিশের গৃহিণীদের মতো সুতি কাপড়ের তৈরি প্যান্টি পরে হাজির হয়ে যেত হাবারার ফ্ল্যাটে (যদিও মাঝবয়সী গৃহিণীরা সুতির প্যান্টি পরে, এটাও হাবারার অনুমান। এ সংক্রান্ত তার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই)। রাস্তার ধারে শস্তা দরদামের দোকান থেকে যে জিনিস কেনা যায়। আবার কোনো কোনো দিন সে খুব দামি, উত্তেজক প্যান্টি পরে হাজির হতো। হাবারার কোনো অনুমান ছিল না যে সে কোথা থেকে এ জিনিস কিনেছে, কিন্তু দেখলেই বোঝা যেত এই বস্তু অনেক দামি, সিল্কের কাপড়ের ওপর গাঢ় রং ডাই করে বানানো। একেক দিন এরকম সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী সাজসজ্জার কী হেতু? অনেক চিন্তাভাবনা করেও হাবারা কোনো কূলকিনারা করতে পারত না।

অন্য যে ব্যাপার হাবারাকে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখত, তা হলো—তাদের যৌনক্রিয়া শেষে শেহেরজাদের গল্প বলা। সংগম আর শেহেরজাদের গল্প, এই দুই কাজ এমনভাবে একটা অপরটার সঙ্গে মিশে ছিল যে কখন একটা শেষ হয়ে আরেকটা শুরু হয়, এটা আলাদা করা ছিল সম্পূর্ণ অসম্ভব। এরকম কোনো অভিজ্ঞতা হাবারার জীবনে আগে কখনো ছিল না। সে মেয়েটাকে ভালোবাসত না, তাদের যৌনক্রিয়াও খুব গভীর আবেগপূর্ণ ছিল না, তবুও সে শারীরিকভাবে এত ভয়াবহ এক টান অনুভব করত শেহেরজাদের প্রতি, যা ছিল ব্যাখ্যাতীত। এটাই, শেহেরজাদের সঙ্গে তার সম্পর্ককে আরও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তুলেছিল।

“আমি যখন টিনএজার, তখন আমি মানুষের খালি বাড়ির তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করা শুরু করি,” একদিন বিছানায় শুয়ে সে হাবারাকে বলল।

হাবারা, অধিকাংশ দিনের মতো এবারও প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য কোনো উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পেল না।

“তুমি কখনো এভাবে কারও বাড়ির তালা খুলে ভেতরে ঢুকেছ?” সে প্রশ্ন করে।

“মনে পড়ে না,” হাবারা শুকনো গলায় উত্তর দেয়।

“একবার শুরু করলেই নেশা ধরে যায়।”

“কিন্তু কাজটা তো বেআইনি।”

“তা তো বটেই। একবার পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তারা তোমার বাপ-মার নাম ভুলিয়ে দেবে। বাড়ির লোকেদের অনুপস্থিতিতে তালা ভেঙে বাড়িতে অনুপ্রবেশ, তারপর ডাকাতি, অন্তত ডাকাতির প্রচেষ্টার অভিযোগ। খুবই সিরিয়াস ব্যাপার। বিপজ্জনক। কিন্তু একবার নেশা ধরে গেলে আর উপায় নেই।”

হাবারা চুপচাপ তার পরবর্তী বক্তব্য শোনার জন্য অপেক্ষা করে।

“একটা শূন্য বাড়িতে, যখন তার বাসিন্দাদের কেউই নেই, এমন সময়ে অনুপ্রবেশের সবচে জোস ব্যাপারটা হচ্ছে বাড়ির সুনসান নীরবতা,” শেহেরজাদ বলে। “কোনো আওয়াজ নেই, যেন হঠাৎ করেই পৃথিবীর নির্জনতম স্থানের খোঁজ পেয়ে যাওয়া। যখন আমি এমন একটা জনশূন্য বাড়ির মেঝেতে চুপচাপ, একদম স্থির হয়ে বসে থাকতাম, মনে হতো যে আমি আমার ল্যাম্প্রে জীবনে ফেরত এসেছি। অসাধারণ এক অনুভূতি, যা সম্পূর্ণ বাস্তব। কোনো কল্পনা বা আরোপিত ব্যাপারস্যাপার নেই। আমি তোমাকে আমার ল্যাম্প্রে-পূর্বজন্মের কথা বলেছিলাম তো, তাই না?”

“হ্যাঁ, বলেছিলে।”

“ঐ অনুভূতিটা একদম সেরকম ছিল। যেন আমার ছাকনি জোরে চুষে ধরেছে পানির নিচে পড়ে থাকা কোনো পাথরকে, আর আমার শরীর সামনে পিছনে দুলছে আস্তে আস্তে, আমাকে ঘিরে রাখা জলজ লতাগুল্মের মতো। সবকিছু একদম নীরব, চুপচাপ। ওহ, সবকিছু সুনসান হয়ে হওয়ার কারণ হয়তো এটা ছিল যে—ল্যাম্প্রে হিসেবে আমার কোন কান, তথা শ্রবণেন্দ্রিয় ছিল না। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনগুলোতে পানির ওপরিভাগ থেকে সূর্যালোক একদম তিরের মতো এসে আমার শরীরে বিঁধত। আবার সময়ে সময়ে তা আলো ঝলমলে এক প্রিজমে পরিণত হয়ে যেত। বিবিধ রং আর আকৃতির মাছ আমাকে ঘিরে সাঁতার কাটত। এদিকে আমার মস্তিষ্ক ছিল সমস্ত চিন্তা থেকে ফাঁকা। মানে, ল্যাম্প্রেরা যেসব চিন্তা করা, তা ছাড়া অন্য সব চিন্তা থেকে ফাঁকা। একটু ধোঁয়াশাচ্ছন্ন, কিন্তু বিশুদ্ধ। ঐ জায়গার চিন্তাপ্রবাহের স্রোত একদম স্বচ্ছ নয়, কিন্তু তাতে কোনো খুঁত নেই। আমি টের পেতাম যে ঐ জায়গাটায় বসে আমি আমিই থাকতাম, আবার আমার সত্ত্বাকে অতিক্রম করে পরিণত হতাম সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছুতে। বসবাসের জন্য কী সুন্দর এক পরিস্থিতি সেটা!”

জীবনে প্রথমবারের মতো বাসিন্দাদের অনুপস্থিতিতে শূন্য বাড়িতে তালা ভেঙে অনুপ্রবেশ করার অভিজ্ঞতা শেহেরজাদের হয়েছিল যখন সে জুনিয়র স্কুলে পড়ে এবং সে তার ক্লাসের একটি ছেলের একদম ভাঙচুর রকমের প্রেমে পড়ে যায়। ছেলেটা সেরকম চোখধাঁধানো আকর্ষণীয় টাইপের কিছু ছিল না, কিন্তু সে ছিল লম্বা, ছিপছিপে গড়নের, ভালো ছাত্র, আবার একই সঙ্গে সে স্কুলের সকার টিমের হয়ে ফুটবল খেলত। এসব কিছু মিলিয়েই সে ছেলেটার প্রতি তুমুলভাবে আকর্ষিত হয়ে পড়ে। কিশোরী বয়সে প্রেমে পড়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নেহায়েত অপ্রতুল নয়, কিন্তু ছেলেটার প্রতি শেহেরজাদের আকর্ষণের ব্যাপারটা ছিল এতটা একপেশে যে, তার কোনো প্রতিক্রিয়া ওপাশ থেকে আশা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া ছেলেটা তার ক্লাসের আরেকটি মেয়েকে পছন্দ করত, ফলে শেহেরজাদের ভালোবাসার দিকে নজর দেয়ার ফুসরতও ছিল না তার হাতে। শেহেরজাদের সঙ্গে তার একবারের জন্যও মুখোমুখি কথাবার্তা হয়নি, কাজেই শেহেরজাদের মতো কেউ যে ক্লাসে আদৌ আছে, সেটাই হয়তো তার জানা ছিল না। তবুও শেহেরজাদ ছেলেটাকে তার মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছিল না। ওকে স্রেফ চোখের সামনে একবার দেখলেই শেহেরজাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত, কখনো কখনো মনে হতো পেটের ভেতর যা আছে, নাড়িভুঁড়ি উলটে সব বেরিয়ে আসবে। যদি এর একটা বিহিত করা না যায়, শেহেরজাদ ভাবল, তবে তাকে পাগল হয়ে যেতে হবে। কিন্তু ছেলেটাকে ভালোবাসা জ্ঞাপন করা ছিল তার জন্যে অসম্ভব। সে মনে করত যে, এটা করতে গেলেই সব তছনছ হয়ে যাবে।

একদিন শেহেরজাদ তার সকালের ক্লাস বাদ দিয়ে সেই ছেলেটার বাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। তার নিজের বাড়ি থেকে ছেলেটার বাড়ি ছিল হাঁটাপথে পনেরো মিনিটের দূরত্ব। সে আগেই তার পরিবারের লোকদের গতিবিধি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা করে রেখেছিল। ছেলেটার মা পাশের শহরের একটি স্কুলে জাপানিজ ভাষা শেখাতেন। আর তার বাবা, যে কিনা একটি সিমেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করত, সে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায় বছরখানেক আগে। আর তার বোন ছিল জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্রী। অর্থাৎ, দিনের বেলা সাধারণত বাড়িটা পুরো খালিই পড়ে থাকে।

স্বাভাবিকভাবেই, বাড়ির সদর দরজায় তালা লাগানো ছিল। শেহেরজাদ দরজার সামনের পাপোশের নিচে চাবি খুঁজে দেখল এবং পেয়েও গেল। প্রাদেশিক শহরের এ সমস্ত নিভৃতচারী আবাসিক এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কম ছিল। কাজেই এখানকার মানুষজন মোটামুটি দুশ্চিন্তা ছাড়াই সদর দরজার সামনের পাপোশের নিচে, বা ফুলগাছের টবের মধ্যে একটা অতিরিক্ত চাবি রেখে যেত।

তবুও, নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে শেহেরজাদ একবার কলিংবেল টিপল। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল ভেতর থেকে কারও উত্তর আসার। রাস্তার এপাশ-ওপাশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল, পাছে তার ওপর কেউ লুকিয়ে লুকিয়ে নজরদারি করছে কি না। তারপর সে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে সদর দরজার তালা ভেতর থেকে লক করে দিল। জুতোজোড়া খুলে হাতে নিয়ে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফেলল। তারপর তা ঝুলিয়ে দিল তার কাঁধের ব্যাগের সঙ্গে। তারপর সে পায়ে পায়ে হেঁটে চলে গেল বাড়ির দ্বিতীয় তলায়।

শেহেরজাদের অনুমানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেল, ছেলেটার কক্ষ বাড়ির এই তলাতেই। কাঠের তৈরি তার সরু, পরিচ্ছন্ন বিছানাটি সামনেই বিছানো। আরও আছে একটি বুকশেলফ, কাপড় রাখার একটি দেরাজ, বসে পড়াশোনা করার মতো একটি টেবিল। বুকশেলফের ওপরে আছে একটি ছোট স্টেরিও সিডি-ক্যাসেট প্লেয়ার, সঙ্গে কিছু সিডি। দেয়ালে ছিল একটি ক্যালেন্ডার, তাতে বার্সেলোনা ফুটবল টিমের খেলোয়াড়দের ছবি। পাশেই ঝুলন্ত ছিল সম্ভবত সেই ক্লাবের ব্যানার। স্রেফ এটুকুই। আর কোনো পোস্টার বা ছবি—কিছুই ছিল না দেয়ালে। ক্রিম রঙের দেয়াল। জানালার ওপরে ঝুলন্ত সাদা রঙের পর্দা। রুমটা ছিল খুবই গোছানো, প্রতিটি জিনিস ছিল নিজ নিজ জায়গায়। কোনো বই উলটেপালটে পড়ে ছিল না এখানে সেখানে, মেঝেতে পড়ে ছিল না কোনো কাপড়। প্রতিটা কলম এবং পেনসিল ছিল তাদের জন্য নির্ধারিত স্থানে। কক্ষটি তার বাসিন্দার দারুণ নিয়মতান্ত্রিক এবং পরিচ্ছন্নতাপ্রিয় চরিত্রের স্মারক হয়ে আছে। অথবা, এও হতে পারে যে এই ঘরের গৃহিণী, তথা ছেলেটার মা সবকিছু একদম গুছিয়ে টিপটপ করে রাখতে পছন্দ করে। অথবা হতে পারে দুটোই। কারণ যাই হোক, বিষয়টা শেহেরজাদকে ভীত করে তুলল। কপাল খারাপ, ভাবল সে। যদি রুমটা একটু অগোছাল হতো, শেহেরজাদের এখানে আগমন টের পাওয়ার যো থাকত না। এখন তাকে প্রতিটা পদক্ষেপ খুব সতর্কভাবে ফেলতে হবে। আবার একই সঙ্গে কক্ষটির পরিচ্ছন্নতা এবং সহজ-সাধারণভাব, গোছানো চেহারা তাকে আনন্দিত করে তুলেছিল। ছেলেটা নিজে যেমন, তার কক্ষও তার মতোই গোছানো।

শেহেরজাদ ডেস্কের সঙ্গে যুক্ত চেয়ারটায় বসল একটু। কম্পিত হৃদয়ে সে ভাবল, এইখানে বসেই ছেলেটা প্রতিরাতে পড়াশোনা করে। একে একে টেবিলের ওপর রাখা ছোট ছোট সমস্ত বস্তু সে নেড়েচেড়ে দেখে, আঙুলের ফাঁকে ঘোরায় ফেরায়, ঘ্রাণ নেয়, ঠোঁটের সঙ্গে চেপে ধরে চুমু খায়। পেনসিল, কাঁচি, রুলার, স্টেপলার, ক্যালেন্ডারের মতো অতি সাধারণ সব জিনিস, শুধুমাত্র সেই ছেলেটার মালিকানার অধীন হবার কারণেই খুব বিশেষ লাগছিল শেহেরজাদের কাছে।

এরপর সে টেবিলের ড্রয়ারটা খুলে ভেতরের জিনিসগুলো দেখল মনোযোগ দিয়ে। ড্রয়ারের একদম ওপরের অংশ বেশ কয়েকটা ভাগে বিভক্ত ছিল। আর এই শ্রেণিভাগ বোঝা যাচ্ছিল ছোট ছোট ট্রের উপস্থিতিতে, যাদের মধ্যে ছিল বেশকিছু টুকিটাকি বস্তু, স্যুভেনিয়র। দ্বিতীয় ড্রয়ারটি ভর্তি ছিল এই বার্ষিকীতে তার নিত্য ব্যবহার্য নোট বইখাতায়। আর একদম নিচের ড্রয়ার ছিল পুরাতন কাগজপত্র, পরীক্ষার খাতা আর নোটবুকে ভর্তি। প্রায় সবকিছুই ছিল তার পড়াশোনা অথবা ফুটবল সংশ্লিষ্ট। গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। শেহেরজাদ মনে মনে খুঁজছিল ওর ব্যবহৃত খুব ব্যক্তিগত কোনো এক জিনিস। হয়তো বা একটা ডায়েরি, অথবা ওর চিঠির বান্ডিল। কিন্তু ডেস্কে এমন কিছুই ছিল না। এমনকি একটা ছবিও না। এটা শেহেরজাদের কাছে একটু অস্বাভাবিক ঠেকল। স্কুল আর ফুটবলের বাইরে ওর জীবন বলতে কি আর কিছুই নেই? নাকি বাদবাকি সবকিছু সে খুব গোপনে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে, যাতে হুট করে কারও চোখে না পড়ে?

তবুও, ছেলেটার টেবিলে বসে, তার লেখার খাতার ওপর চোখ বুলিয়েই শেহেরজাদ গভীরভাবে আলোড়িত হলো। টের পেল, এখনই কিছু একটা না করলে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। নিজেকে শান্ত করতে সে চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়ল। তাকিয়ে রইল কক্ষের ছাদের দিকে। তার আশপাশে বিরাজমান ছিল প্রগাঢ় নীরবতা। বিন্দুমাত্র শব্দ ছিল না কোথাও। এভাবে সে পুনরায় প্রবেশ করল তার ল্যাম্প্রে জগতে।

“তাহলে এই ছিল পুরো ব্যাপারটা,” হাবারা প্রশ্ন করে, “সকলের অনুপস্থিতিতে ঘরে ঢোকা, ছেলেটার জিনিসপত্র খানিকক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করা, আর তারপর মেঝেতে বসে থাকা?”

“না,” শেহেরজাদ উত্তর দেয়। “আরও ব্যাপার ছিল। আমি চাইছিলাম ওর একটা স্মৃতি আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে। এমন কিছু, যা তার দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। যাতে ওর শরীরের স্পর্শ লেগে আছে। কিন্তু সেটা এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুও হতে পারবে না, যার উপস্থিতি ওর চোখে ধরা পড়ে যাবে হুট করে। কাজেই আমি ওর ডেস্ক থেকে একটা পেনসিল উঠিয়ে নিলাম।”

“একটা পেনসিল মাত্র?”

“হ্যাঁ। একটা ব্যবহৃত পেনসিল। নতুন না। কিন্তু, ওর একটা জিনিস স্রেফ তুলে নিয়ে এলে কাজটা কোনো ছিঁচকে চোরের চুরি করার মতো সোজাসাপটা চুরি করাতেই পরিণত হবে। কাজটা যে আমিই করেছি, তার কোনো প্রমাণ থাকবে না, অথচ তা জরুরি। কারণ, আমি তো প্রেমের তাড়নাতেই চুরিটা করছি, তাই না?”

‘প্রেমশিকারি’—হাবারার মনে এক সিনেমার নাম ভেসে ওঠে।

“কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, স্মৃতিস্মারকস্বরূপ আমার নিজের কিছু একটা জিনিসও আমি ঐ কামরায় রেখে যাব। যেটা প্রমাণ বহন করবে যে, আমি ছিলাম ওখানে। যা বোঝাবে যে আমাদের মধ্যে বিনিময় ঘটেছিল, আমি কেবল চুরি করিনি। কিন্তু জিনিসটা কী হতে পারে? আমার মাথায় আসছিল না কিছু। আমি আমার ব্যাগ, আমার পকেট হাতড়ে জুতসই কিছু খুঁজে পেলাম না। মনে মনে নিজের গালে চড় কশালাম সজোরে, ওর জন্য উপহার হিসেবে রেখে আসবার জন্য উপযুক্ত কিছু সঙ্গে না নিয়ে যাওয়ার কারণে। শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিলাম, পিরিয়ডকালীন সময়ে ব্যবহার করার একটা ট্যাম্পুন ব্যাগ থেকে বের করে ওর জন্য রেখে আসব। অবশ্যই অব্যবহৃত, এখনও প্লাস্টিকের মোড়কে আছে এমন। আমার পিরিয়ডের সময় ঘনিয়ে আসছিল, তাই বেশকিছু ট্যাম্পুন এমনিতেই আমি সঙ্গে নিয়ে ঘুরতাম। জিনিসটা আমি ওর টেবিলের ড্রয়ারগুলোর একদম নিচের ড্রয়ারের একেবারে পেছনে রেখে দিলাম, যেখানে চট করে কারও চোখ পড়ার সুযোগ নেই। কাজটা শেষ করে আমি ভেতরে ভেতরে বেশ খানিকটা উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। আমার একটা ট্যাম্পুন এখন থেকে ওর টেবিলের ড্রয়ারে থাকবে, ব্যাপারটা আমাকে ভেতর থেকে তাতিয়ে তুলল। আমি এতটাই কামোত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম যে, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে গিয়েছিল।”

পেনসিলের বদলে একটা ট্যাম্পুন! হাবারা ভাবল, তার আজকের ডায়েরির শিরোনাম এরকম কিছু একটা হওয়া উচিত : ‘প্রেমশিকারি, পেনসিল, ট্যাম্পুন।’ তার মন চাইল তখনই শব্দগুলো একবার পাশাপাশি লিখে ফেলতে।

“ঐ বাড়িতে আমি সব মিলিয়ে পনেরো মিনিটের মতোই ছিলাম। এর চেয়ে বেশি সময় আমার ওখানে থাকা হয়নি, কারণ এর আগে কখনো আমি কারও বাড়িতে এভাবে ঢুকিনি, আর প্রতিমুহূর্তেই আমার ভয় হচ্ছিল যে—যেকোনো মুহূর্তে কেউ হয়তো দরজা খুলে ঢুকে পড়বে। আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম আশপাশের রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না। তারপর খুব সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে তা পুনরায় লক করলাম। চাবিটা রেখে দিলাম আগের জায়গায়। এরপর আমি স্কুলে গেলাম। আমার ব্যাগে তখন ওর একটা পেনসিল।”

শেহেরজাদ চুপ হয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল যেন ওর চৈতন্যপ্রবাহে ফিরে ফিরে আসছিল অতীতদিনের হারানো সব স্মৃতি, একের পর এক, ধারাবাহিকভাবে।

“সেই সপ্তাহটা ছিল আমার পুরো জীবনের সবচেয়ে আনন্দদায়ক সপ্তাহ,” দীর্ঘ বিরতির পর সে মুখ খুলল। “আমার নোটবুকে সেই পেনসিলটা দিয়ে নানা হাবিজাবি লিখেছিলাম। ঘ্রাণ নিয়েছিলাম পেনসিলটার বারবার, চুমু খেয়েছি, গালে ঘষেছি অনেকক্ষণ ধরে, আঙুলের মাঝে নিয়ে খেলা করেছি। কখনো কখনো ওটাকে মুখে পুরে চুষেছি পর্যন্ত। ক্রমাগত ব্যবহার করার ফলে ক্রমশ ওটা ছোট হয়ে আসছিল এবং তা আমাকে কষ্ট দিচ্ছিল। কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, আবার গিয়ে আরেকটা পেনসিল নিয়ে আসা যাবে। পুরো একমুঠো ব্যবহৃত/অর্ধ ব্যবহৃত পেনসিল ওর টেবিলের কলমদানিতে আছে। ওখান থেকে আরও একটা কমে গেলে ও ধরতে পারবে না মোটেও এবং এখনও সম্ভবত ও আমার ট্যাম্পুনটা খুঁজে পায়নি, যা রেখে এসেছিলাম ওর টেবিলের একদম নিচের ড্রয়ারে। ওর বাড়িতে আবারও প্রবেশ করার পুরো ভাবনাটা আমাকে পুনরায় উত্তেজিত করে তুলল, যেন আমার নাভির নিচে কেউ আলতো ছোঁয়ায় সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। নিজেকে শান্ত রাখবার জন্য আমার শক্ত করে হাঁটু আঁকড়ে বসে থাকতে হয়েছিল। বাস্তবের দুনিয়ায় ও যে কখনো আমার দিকে ফিরেও তাকায় না, অথবা ওর জগতে আমার যে অস্তিত্বমাত্রও নেই—এই ব্যাপারটা আমাকে আর কষ্ট দিচ্ছিল না। কারণ গোপনে ওর খুব ব্যক্তিগত ব্যবহার্য একটা জিনিস, ওর একটা অংশই বলতে গেলে তখন আমার দখলে ছিল।”

“এ তো জাদুটোনা করবার মতো ব্যাপার,” হাবারা বলে।

“হ্যাঁ, অনেকটা জাদু করবার মতোই। এটা অবশ্য আমি পরে বুঝেছিলাম, ব্ল্যাকম্যাজিক সংক্রান্ত একটা বই পড়ার মাধ্যমে। কিন্তু তখন তো আমি স্রেফ হাই স্কুলের ছাত্রী, অত তলিয়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত ছিলাম না। আমি কেবল আমার কামনার টানে ভেসে ভেসে সামনে এগুচ্ছিলাম। আমি জানতাম, যদি ওর বাড়িতে এভাবে নিয়মিত আমি প্রবেশ করতে থাকি তো এর জন্য একদিন আমাকে কড়া মাশুল গুনতে হবে। একবার ধরা খেলে সম্ভবত আমাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করে দেয়া হতো এবং কথাটা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়লে সে শহরে বাস করাও আমার জন্য অসম্ভব হয়ে যেত। নিজেকে বারবার বারবার ব্যাপারটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কাজ হয়নি কোনো। আমার মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না তখন।

দশ দিন পর শেহেরজাদ আবারও স্কুল বাদ দিয়ে ছেলেটার শূন্য ঘরে গিয়ে প্রবেশ করে, দ্বিতীয়বারের মতো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল এগারোটা। গতবারের মতোই সদর দরজার সামনের পাপোশের নিচ থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে সে। আগের মতোই ছেলেটার রুম ছিল একদম নিখুঁতভাবে গোছানো। বিছানার চাদরে একটা ভাঁজ পর্যন্ত ছিল না। প্রথমে সে তার কলমদানি থেকে প্রায় অব্যবহৃত একটি পেনসিল তুলে নিয়ে নিজের ব্যাগে ভরল। তারপর সে খুব সতর্কভাবে শুয়ে পড়ল ছেলেটার বিছানার ওপর, হাতদুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে সে তাকিয়ে রইল ঘরের ছাদের দিকে। এই বিছানায়ই ছেলেটা প্রতিদিন শোয়, ঘুমায়—এ কথা ভেবে ওর হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে গেল অনেক, এতটাই যে, ওর পক্ষে স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়াও কষ্টকর হয়ে পড়ল। ওর ফুসফুসে পর্যাপ্ত বাতাস পৌঁছাচ্ছিল না, গলা শুকিয়ে হাড়ের মতো খটখটে হয়ে পড়েছিল। প্রতিটা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ওর জন্য দুঃসহ হয়ে উঠল।

শেহেরজাদ বিছানা থেকে নেমে তার চাদর আবার আগের মতো টানটান করে গুছিয়ে রাখল। তারপর সে মেঝেতে বসে পড়ল, প্রথম দিনের মতো। আবারও সে তাকিয়ে থাকল ছাদের দিকে। আমি ঐ বিছানা ব্যবহার করার জন্য প্রস্তুত নই এখনও, নিজেকে নিজে বলল সে। এখনও এতটা হজম করবার তৈরি শক্তি হয়নি আমার মধ্যে।

এবারে শেহেরজাদ সেই কক্ষে আধাঘণ্টা সময় কাটাল। সে ছেলেটার ড্রয়ার থেকে সমস্ত নোটবুক বের করে পড়ে দেখল। একটা রিপোর্ট বই খুঁজে পেল সে। সোসাকি নাতসুমের লেখা উপন্যাস ‘কোকোরও’র ওপর ওর লিখিত এক পাঠপ্রতিক্রিয়া, যা ছিল ওর গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে স্কুলের দেয়া বাসার কাজ। ছেলেটার হাতের লেখা অত্যন্ত সুন্দর, সব কোর্সে ‘এ’ গ্রেড পাওয়া ছাত্রের যেমনটা হওয়া উচিত, ঠিক তেমনি। কোথাও কোনো ভুল নেই, বিন্দুমাত্র কাটাকাটিও নেই। এটার ওপরে যে গ্রেড তাকে দেয়া হয়েছে, তাও অসাধারণ। আর কীই বা হওয়া সম্ভব? একজন শিক্ষকের সামনে এতটা নিখুঁত হাতে লেখা স্ক্রিপ্ট এসে পড়লে তাকে এক লাইন না পড়েও ‘এক্সিলেন্ট’ গ্রেড দিয়ে দেয়াটাও অস্বাভাবিক নয়।

শেহেরজাদ তার ওয়ার্ডরোবের মাঝের ড্রয়ার খুলে তাতে গুছিয়ে রাখার জিনিসপত্র পর্যায়ক্রমে নেড়েচেড়ে দেখা শুরু করল। সবার ওপরে ছেলেটার জাঙিয়া আর মোজা। তার নিচে শার্ট এবং প্যান্ট। ফুটবল খেলার পোশাক। খুব গুছিয়ে সাজিয়ে রাখা ছিল সবকিছু। কোনোটায় বিন্দুমাত্র দাগ বা অযাচিত ভাঁজ ছিল না।

সবকিছু একদম ঝকঝকে পরিষ্কার আর নিখুঁত আঙ্গিকে ভাঁজ করে রাখা। ছেলেটা নিজেই এত সুন্দর করে ভাঁজ করে? নাকি ওর মা এসব কিছু ভাঁজ করে রেখে দেয়? ওর মাই করে এ কাজ, খুব সম্ভবত। ছেলেটার জন্যে এসব কিছু করার সুযোগ ওর মা প্রতিদিন পায় বলে, ছেলেটার মায়ের প্রতি শেহেরজাদের বেশ হিংসাই বোধ হলো।

শেহেরজাদ ঝুঁকে পড়ে সেই ড্রয়ারে ওর পোশাকের ঘ্রাণ নেয় প্রাণভরে। সবগুলোই যত্ন করে ধোয়ার পর রোদে শুকিয়ে খটখটে করে রাখা। সে ভেতর থেকে একটা ছাইরঙা টি-শার্ট বের করে ভাঁজ খুলে সেটাকে চেপে ধরল তার মুখের ওপর। কোথাও ওর ঘামের একটুখানি গন্ধও কি লেগে নেই? এমনকি বগলের কাছটাতে? কিন্তু না। আদতেই কোনো ঘামের গন্ধ নেই ওটায়। যা হোক, সে আরও কিছুক্ষণ নাকের কাছে চেপে ধরে ঘ্রাণ নিল সে টি-শার্টের। তার মন চাচ্ছিল টি-শার্টটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতে, কিন্তু তা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। ছেলেটার জামাকাপড়গুলো খুবই সাজিয়ে গুছিয়ে ভাঁজ করে রাখা। সে (অথবা তার মা) হয়তো জানে, ঠিক কয়টা টি-শার্ট তার ড্রয়ারে রাখা আছে। একটা হারানো মাত্রই নরক গুলজার হয়ে যাবে।

কাজেই, তার পরিকল্পনা ত্যাগ করে শেহেরজাদ খুব যত্নে ভাঁজ করে টি-শার্টটা আবার জায়গামতো রেখে দিল। খুবই যত্নের সঙ্গে কাজটা করা লাগল তার, যাতে করে ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা না থাকে। বদলে সে তার টেবিলের ড্রয়ার থেকে পেনসিলের সঙ্গে মিলিয়ে একটা ফুটবল আকৃতির ব্যাজ তুলে নিল। জিনিসটা তার গ্রেড-স্কুল জীবনের কোনো ফুটবল টিমের ব্যাজ খুব সম্ভবত। দেখতে বেশ পুরনো এবং অপ্রয়োজনীয়। মনে হয় না সে এটার অভাব বোধ করবে কখনো। অন্তত, এই ব্যাজটা যে হারানো গেছে—সেটা বুঝতে বুঝতেও ওর অনেক সময় লেগে যাবে। এই করতে করতে শেহেরজাদ একদম নিচের ড্রয়ারে আগেরবার রেখে যাওয়া ট্যাম্পুনটাও খুঁজে দেখল। দেখা গেল, সেটা জায়গা মতোই আছে।

শেহেরজাদ একবার চিন্তা করল, ওর মা যদি এই ট্যাম্পুন এখানে দেখতে পায়, তবে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে। কী ভাববেন তিনি? তিনি কি তার ছেলের কাছে ব্যাখ্যা চাইবেন যে কীভাবে তার টেবিলের ড্রয়ারে হুট করে একটা ট্যাম্পুন এসে হাজির হলো? নাকি তিনি তার এই আবিষ্কারকে গোপন রাখবেন, কেবল নিজের মস্তিষ্কের ভেতরেই এই গাঢ় অন্ধকার আবিষ্কার উলটেপালটে চিন্তা করতে থাকবেন প্রতিনিয়ত? এমন খুঁতখুঁতে এক মা, এরকম এক পরিস্থিতিতে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখান? শেহেরজাদের কোনো ধারণা ছিল না। কিন্তু শেহেরজাদ আগের জায়গাতেই ওটা রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যেহেতু সেটা ছিল তার ঐ ছেলেটিকে দেয়া প্রথম কোনো উপহার।

তার দ্বিতীয় ভ্রমণকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য শেহেরজাদ এবার তার তিনটি চুল রেখে যায় তার কামরায়। আগের রাতেই সে এই চুলগুলো মাথা থেকে ছিঁড়ে আলাদা করে একটা প্লাস্টিকে মুড়ে ছোট একটা খামে পুরে রেখেছিল। খামটাকে তার ব্যাগের ভেতর থেকে বের করে সে ছেলেটার ড্রয়ারের ভেতর গণিতের পুরাতন নোটখাতাগুলোর একটার মাঝে ঢুকিয়ে রাখে। তিনটি চুলই ছিল কালো এবং একদম সোজা। খুব লম্বাও না, আবার খাটোও না। ডিএনএ টেস্ট করা ছাড়া এ চুলগুলো যে কার, তা বোঝার আর কোনো উপায় নেই। যদিও দেখেই বোঝার কথা যে চুলগুলো কোনো এক মেয়ের।

তারপর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা স্কুলে চলে এলো, দুপুরের ক্লাসগুলোর প্রথমটি শুরু হবার ঠিক আগে আগে। তার মনে অন্তত পরবর্তী দশ দিন ধরে সন্তুষ্ট থাকবার মতো প্রশান্তি। ছেলেটার সঙ্গে তার সম্পর্ক, কিছুটা ভিন্নভাবে হলেও, অবশেষে একটা রূপ ধারণ করছে। কিন্তু, প্রকৃতির নিয়মেই এ ধরনের কাজকারবার কোনো দুর্ঘটনা ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে একটানা চলতে পারে না। ঘটন বা অঘটন, নসিবে যাই লেখা থাকুক, শেহেরজাদের জন্য পরবর্তীতে মানুষের ঘর ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করাটা নেশায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল।

গল্পের এ পর্যায়ে এসে শেহেরজাদ বিছানার পাশের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ৪টা ৩২ বাজে। “যেতে হবে,” প্রায় বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলল সে কথাটা। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে সে নিজের সাধারণ, তবে আরামদায়ক সাদা রঙের প্যান্টি পরল, ব্রায়ের হুক লাগাল, জিন্সের প্যান্টের ভেতর পা গলিয়ে গাঢ় নীল রঙের সোয়েট শার্টে শরীর ঢেকে ফেলল। বাথরুমে ঢুকে কচলে কচলে হাত ধুলো বেশ খানিকটা সময় নিয়ে, চুল আঁচড়াল, তারপর তার নীল রঙের মাজদা গাড়ি চালিয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল দৃষ্টিপট থেকে।

একাকী ঘরে বসে হাবারার করার মতো কিছুই ছিল না। কাজেই সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গবাদিপশুর জাবর কাটার মতো করে পুরো গল্পটা ছোট ছোট অংশে ভাগ করে আবারও স্মরণ করল। এই গল্পের শেষ কোথায়?—ভাবল সে। শেহেরজাদের অন্যান্য সব গল্পের মতোই, এ গল্পেরও কোনো লেজ-মাথা পাওয়া যাচ্ছিল না। শেহেরজাদকে যদিও হাই স্কুলের ছাত্রী হিসেবে কল্পনা করতে তার খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছিল। সে কি খুব সরু, ছিপছিপে গড়নের ছিল তখন? আজকালকার ফ্যাশন সচেতন মেয়েদের মতো তার শরীরেও কি মেদের লেশমাত্র ছিল না? তার স্কুলের সাজপোশাক ছিল কী? সাদা মোজার সঙ্গে স্কুলের ইউনিফর্ম, সঙ্গে বেণি করা চুল?

হাবারার তখনও তেমন ক্ষুধা লাগেনি, ফলে সে রাতের খাবার রান্না করার বদলে আগে যে বইটা পড়ছিল, সেটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করল। কিন্তু শীঘ্রই সে আবিষ্কার করল, তার পড়ায় মন বসছে না মোটেই। শেহেরজাদের তার সহপাঠীর জনশূন্য বাড়ির দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করা, তার টি-শার্টে মুখ ডুবিয়ে বসে থাকার দৃশ্যগুলো তার মনে ফিরে ফিরে আসছে বারবার। পরে কী ঘটতে চলেছে—এটা আবিষ্কার করার জন্য হাবারা ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে ক্রমাগত।

সাপ্তাহিক ছুটির দিন শেষে, সব মিলিয়ে আরও তিন দিন পর শেহেরজাদ আবারও আসে তার বাড়িতে। প্রতিবারের মতো এবারও তার হাতে বিশাল সাইজের কাগজের ব্যাগে নানা রকম জিনিসপত্র বোঝাই ছিল। সে বয়ে আনা খাবারগুলো নিয়ে সাজিয়ে রাখল ফ্রিজে। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের এক্সপায়ার ডেট মিলিয়ে দেখে ফেলে দিল তাদের কয়েকটা। টিনের কৌটা এবং বোতলজাত খাদ্যদ্রব্যগুলো ভালোভাবে নেড়েচেড়ে দেখল, অন্যান্য মশলা এবং আনাজপাতির কৌটা খুলে কোনটা কী পরিমাণে আছে, তা পরীক্ষা করে দেখল, তারপর সে একটা লম্বা কাগজের ফর্দে পরেরবার কী কী দ্রব্যসামগ্রী আনা লাগবে, তার একটা তালিকা তৈরি করল। পানীয় ভর্তি কয়েকটা বোতল ঠাণ্ডা করবার জন্যে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে সবশেষে সে সঙ্গে করে নিয়ে আসা নতুন বই এবং ডিভিডিগুলো বই রাখবার তাকে গুছিয়ে রাখল।

“কিছু প্রয়োজন আছে এর বাইরে?”

“মনে পড়ছে না এখন,” হাবারা উত্তর দেয়।

তারপর, প্রতিবারের মতো তারা বিছানায় যায় এবং সংগমে লিপ্ত হয়। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ফোরপ্লে করবার পর হাবারা কনডম পরে (শেহেরজাদই মূলত চাইত, যেন হাবারা কনডম ব্যবহার করে), শেহেরজাদের ভেতরে প্রবেশ করে এবং সাধারণত যে পরিমাণ সময় সংগম করবার পর তার বীর্যপাত হয়, সে পরিমাণ সংগমের পরই তার বীর্যপাত ঘটে। তাদের এই সংগমে কোনো জোরজবরদস্তি ছিল না, তেমনি ছিল না কোনো গভীর ভালোবাসার টান। শেহেরজাদই মোটের ওপরে চাইত যেন এই কাজটা মানসিকভাবে খুব আবেগঘনিষ্ঠ না হয়ে ওঠে। যেমন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষক এটা সাধারণত চায় না যে, গাড়ি চালানো শিখতে গিয়ে তার শিক্ষার্থী উৎসাহী হয়ে উঠে নানা কেরদানি প্রদর্শন শুরু করে।

সংগম শেষে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাবারার কনডমের প্যাকেটগুলো কিছুক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর শেহেরজাদ তার গল্পের নতুন কিস্তি শুরু করে।

গতবারের মতোই, ছেলেটার বাড়িতে দ্বিতীয় অনুপ্রবেশের পরবর্তী দশটি দিন তার খুব আনন্দঘন, পরিপূর্ণ এক মানসিক অবস্থায় কাটে। শেহেরজাদ ছেলেটার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা সেই ফুটবল ব্যাজটা নিজের পেনসিল বক্সের ভেতরে নিয়ে ঘুরত, আর ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে ব্যাজটার ওপর আঙুল বোলাত। আর যে পেনসিলটা সে নিয়ে এসেছিল ছেলেটার কলমদানি থেকে, তা প্রায়ই মুখে ঢুকিয়ে কামড়াত, তার শিষের অংশটুকু চাটত জিভ দিয়ে। তার মাথায় কেবল ছেলেটার সে কক্ষটাই ঘুরপাক খেত। তার বসার টেবিল, শোয়ার বিছানা, পোশাক ঠাসা তার দেরাজ, তার ধবধবে সাদা জাঙিয়া, টেবিলের নিচের ড্রয়ারের একদম পেছনে রেখে আসা তার ট্যাম্পুন, তিন গাছি চুল, এই সব।

একবার জনশূন্য বাড়িতে ঢোকা শুরু করবার পর তার স্কুল, পড়াশোনা—সবকিছু থেকে আগ্রহ উঠে গিয়েছিল একদম। মন বসত না এসবে, কিছুতেই। পুরো ক্লাস তার কাটত ছেলেটার বাসা থেকে নিয়ে আসা পেনসিল বা ব্যাজ নাড়াচাড়া করে, অথবা দিবাস্বপ্ন দেখে দেখে। বাড়ি ফিরে আসার পর স্কুল থেকে বাড়ির কাজ করার মতো মানসিক অবস্থা থাকত না তার। পরীক্ষার গ্রেড ম্যানেজ করা শেহেরজাদের জন্য খুব বড় কোনো সমস্যা ছিল না কখনো। ক্লাসের সেরা স্টুডেন্ট না হলেও সে নিয়মিত তার বাড়ির কাজ-অ্যাসাইনমেন্ট ইত্যাদি করত। এতটুকু মনোযোগ তার পড়াশোনা নিয়ে ছিল বরাবরই। কাজেই যখন তার শ্রেণিশিক্ষক একদিন শেহেরজাদকে ডেকে তার পড়াশোনায় অবনতির কারণ জিজ্ঞেস করলেন, শেহেরজাদ কোনো উত্তর দিতে পারল না। তার শিক্ষক এতে রাগ করার বদলে অবাক হলেন আরও বেশি। একদিন দুপুরের লাঞ্চব্রেকে তিনি শেহেরজাদকে তার অফিসরুমে ডাকলেন। “কী সমস্যা তোমার, বলো তো?” তিনি প্রশ্ন করলেন শেহেরজাদকে। “কিছু নিয়ে চিন্তিত তুমি?” এই প্রশ্নের জবাবেও শেহেরজাদ আমতা আমতা করে শরীর খারাপ বা এই ধরনের কিছু অস্পষ্ট উত্তর দিয়ে সে যাত্রা কোনোক্রমে পার পেল। কেননা, আর যাই হোক, তার পক্ষে এটা তার শিক্ষককে বলা সম্ভব ছিল না যে—বিষয় হচ্ছে স্যার, আমি আমাদের ক্লাসের এক ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। ইদানীং যখন তার বাড়িতে কেউ থাকে না, এমন সময় আমি সে বাড়িতে প্রবেশ করে তার ব্যবহৃত সমস্ত জিনিসপত্র উলটেপালটে নেড়েচেড়ে দেখি। এই করতে করতে এখন পর্যন্ত ওর দুটো পেনসিল, আর ব্যাজ আমি আমার ব্যাগে ভরে নিয়ে এসেছি। এখন পুরো ক্লাস ওর ঐ ব্যাজ আর পেনসিল নাড়াচাড়া করতে করতেই আমার সময় কাটে। ওর চিন্তা ছাড়া আমার মাথায় আর কিছু ঢোকে না সারা দিন। শেহেরজাদের এই গোপন তথ্যটুকু ছিল অন্ধকার আর ভারী, চাইলেই সে কারও সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে পারত না।

***

“আমার ওভাবে ওর ঘরে ঢোকা লাগতই,” শেহেরজাদ বলল। “আমার নেশা ধরে গিয়েছিল। বুঝতেই পারছ কতটা বিপজ্জনক কাজ ছিল ওটা। আজীবন অনেক উঁচুতে ঝুলতে থাকা একটা সরু রশির ওপর হেঁটে যাব, তা সম্ভব ছিল না আমার জন্য। আমি নিজেও সেটা বুঝতে পারছিলাম। আজ হোক অথবা কাল, কেউ না কেউ আমাকে ঐ অবস্থায় ধরে ফেলত, পুলিশ ডাকত। এই চিন্তায় আমি ভেতরে ভয়ে ভয়ে মারা পড়তাম বারংবার। কিন্তু একবার বল কোর্টে গড়িয়ে দেয়ার পর থামাথামির আর কোনো উপায় ছিল না। দ্বিতীয়বার ওর ঘরে ঢোকার আরও দশ দিন পর, আবারও আমি সেখানে গেলাম। আমি গেলাম বললে ভুল হবে, আমার পা যেন নিজে নিজেই আমাকে টেনে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিল ওর বাড়ির দরজায়। আমার কিছু করার ছিল না। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যদি এটা না করি তো আমি পাগল হয়ে যাব। সে দিনগুলোর কথা ভাবলে মনে হয়, আসলেই তখন আমার মাথায় খানিকটা সমস্যা ছিল।”

“এভাবে নিয়মিত ক্লাস ফাঁকি দেয়ায় তোমার স্কুলে সমস্যা হতো না?” হাবারা প্রশ্ন করে।

“আমার বাবা-মা দুজনেই নিজ নিজ কাজেই ব্যস্ত থাকত সারা দিন। আমাকে নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমি সে পর্যন্ত তাদের জন্য কোনো সমস্যা তৈরি করিনি, তাদের কোনো কথার অবাধ্যও হইনি কখনো। কাজেই তারা ধরে নিয়েছিল, আমাকে আমার মতো চলতে দেয়াটাই ভালো হবে। স্কুলের মাস্টারদের বুঝ দেয়ার জন্য অভিভাবকের ভুয়া দরখাস্ত লেখাটা আমার জন্য ছিল বাম হাতের খেল। মায়ের হাতের লেখা আমি খুব ভালো করে নকল করতে পারতাম। কাজেই আমি খুব সাধারণ একটি দরখাস্তে আমার, তথা তার সন্তানের অনুপস্থিতির কারণ ব্যাখ্যা করে মায়ের দস্তখত নকল করতাম, পরে তার একটা সিল দিয়ে দিতাম। আমি আমার শ্রেণিশিক্ষককে বুঝিয়েছিলাম যে, আমার এমন একটা রোগ আছে, তার রুটিন চেকআপের জন্য আমাকে প্রায়ই দিনের অর্ধেকটা হাসপাতালে কাটাতে হয়। স্কুলের শিক্ষকদের এমনিতেই মাথায় গরম থাকত দিনের পর দিন স্কুলে আসে না এমন বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে। আমার মতো একজন, যে মাঝেসাঝে অর্ধেক বেলা স্কুল ফাঁকি দেয়—তাকে নিয়ে তাদের তেমন মাথাব্যথা ছিল না।”

গল্পের পরবর্তী অংশ বলার পূর্বে শেহেরজাদ দ্রুত বিছানার পাশের ঘড়িতে একবার চোখ বুলায়।

“আবারও বাড়ির দরজার সামনের পাপোশের নিচ থেকে চাবি কুড়িয়ে তৃতীয়বারের মতো আমি ছেলেটার বাড়িতে প্রবেশ করলাম। প্রতিবারের মতোই বাড়িটা নীরব, নিস্তব্ধ ছিল। না, আসলে সেবার আরও বেশি নীরব ছিল বাড়িটা, জানি না কেন। ওদের রেফ্রিজারেটর হঠাৎ শব্দ করে উঠলে আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠছিলাম। যেন এক জন্তু ওটা, নিঃশ্বাস নিচ্ছে টেনে টেনে।

আমি বাড়িতে ঢোকার মুহূর্তখানেকের মধ্যে বাড়ির ফোন বেজে উঠল খুব জোরে। এত কর্কশ সুরে সেটা বাজছিল যে ভয়ে আমার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য। ঘেমে নেয়ে উঠেছিলাম পুরো। কেউ ফোন না ধরায় টানা দশবার বেজে ওটা আপনাতেই বন্ধ হয়ে যায়। পুরো ঘর আগের চেয়ে আরও বেশি নীরব, নিস্তব্ধ হয়ে ওঠে।

শেহেরজাদ বলে, সে সেদিন আরও দীর্ঘক্ষণ ধরে ছেলেটার বিছানায় টানটান হয়ে শুয়েছিল। এবার আর তার হৃদস্পন্দন আগেরবারের মতো পাগলা ঘোড়ার বেগে ছোটেনি। সে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে-ত্যাগ করতে পারছিল। সে কল্পনা করছিল যে ছেলেটা এ মুহূর্তে তার পাশেই ঘুমিয়ে আছে, যেন হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যাবে তার পেশিবহুল হাত, শরীর। বাস্তবে তো সে অবশ্যই তার পাশে ছিল না। এসবই ছিল তার দিবাস্বপ্নের অংশ।

হঠাৎ শেহেরজাদের ভেতরে ছেলেটার শরীরের ঘ্রাণ নেয়ার এক অলঙ্ঘনীয় দুর্দম বাসনা জেগে ওঠে। সে বিছানা ছেড়ে উঠে হেঁটে হেঁটে ছেলেটার ওয়ার্ডরোবের কাছে যায়। ড্রয়ার খুলে ভেতরের জামাগুলো দেখে গভীর মনোযোগে। প্রতিটা জামাই ধুয়ে পরিষ্কার করে সূর্যের আলোতে শুকিয়ে খটখট করে, তারপর আয়রন করে রাখা হয়েছে এখানে। একদম নিখুঁত, ওর শরীরের কোনো ঘ্রাণ নেই এতে। বরং পেস্ট্রির দোকানে ডিসপ্লেতে সাজিয়ে রাখা কেক-পেস্ট্রির মতো পিস পিস করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এই ড্রয়ারে। যেন একদম নতুন কেনা কাপড়চোপড় সব। ব্যবহার করা হয়নি কখনো।

তারপর হঠাৎ তার মাথায় এক পরিকল্পনা এলো। সে এক দৌড়ে নিচতলায় চলে এলো। স্নানঘরের পাশে, ধোয়ার জন্য ফেলে রাখা ব্যবহৃত কাপড়চোপড়ে ভর্তি বাস্কেটের ঢাকনা সরিয়ে শেহেরজাদ দেখল—তাতে মা, মেয়ে, আর ছেলে, পরিবারের তিনজনেরই ব্যবহৃত পোশাক মিলেমিশে ধোয়ার অপেক্ষায় পড়ে আছে। এমনকি এই কাপড়গুলো দেখেও মনে হয় যে তাদের একবারের বেশি ব্যবহার করা হয়নি। শেহেরজাদ সেই কাপড়চোপড়ের মধ্য থেকে ছেলেটার একটি সাদা রঙের গোলগলা টি-শার্ট তুলে নিল। তারপর সে গেঞ্জিটা নাকের কাছে ধরে শুঁকল একবার। আহ, এক টগবগে তরুণের শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে আছে এর পরতে পরতে! ছেলে সহপাঠীরা গা ঘেঁষে দাঁড়ালে যে ভ্যাপসা এক ছেলে ছেলে ঘ্রাণ পাওয়া যায় তেমনই একটা গন্ধ। খুব উত্তেজক নয়। কিন্তু এই ঘ্রাণ শেহেরজাদের পুরো শরীর-মন এক ব্যাখ্যাতীত আনন্দে উদ্বেল করে তোলে। যখন সে তার নাক ঐ টি-শার্টের বগলে ঠেকিয়ে শ্বাস নিল বড় করে, তার মনে হলো যেন সত্যি সত্যি ছেলেটা তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, আর তার হাতের নিচ থেকে সে ঘ্রাণটা এসে তার নাকে লাগছে।

টি-শার্টটা হাতে করে শেহেরজাদ আবারও ছুটে দোতালায়, ছেলেটার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হলো। বিছানায় শুয়ে পড়ে সে বুভুক্ষের মতো ঘ্রাণ নিতে থাকল ঘর্মাক্ত সে টি-শার্টের। একই সঙ্গে সে টের পেল, তার নাভির নিচে ধীরে ধীরে খুব উত্তেজক এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছে। তার স্তনবৃন্তও শক্ত হয়ে উঠছে। পিরিয়ডের দিন কি ঘনিয়ে এসেছে তবে? না, এত আগে তো তা হবার কথা না। এটা কি তবে যৌনাকাক্সক্ষা? তাই যদি হয়ে থাকে, তবে সে এখন কী করবে? এর নিবারণের কী উপায়? শেহেরজাদ অনেক চিন্তাভাবনা করেও কোনো কূলকিনারা করতে পারে না। তবে একটা জিনিস তার সেই উন্মাতাল অবস্থাতেও খেয়াল ছিল, এ জায়গায়, এ বিছানার ওপর কিছুই করা যাবে না।

শেষমেশ শেহেরজাদ সিদ্ধান্ত নিল যে সে এই ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা তার ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে যাবে। কাজটা নিঃসন্দেহে ঝুঁকিপূর্ণ। ওর মা নিশ্চিত ধরে ফেলবে যে, ধোয়ার জন্যে রাখা জামাকাপড়ের মাঝে একটা টি-শার্ট উধাও হয়ে গেছে। যদি সে এটা চুরি যাবার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে নাও পারে, সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাথা ঝাঁকাবে আর ভাববে, এখানে একটা গেঞ্জি থাকার কথা, গেল কই সে গেঞ্জিটা! একজন মহিলা, যে নিজের ঘর এতটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে, সে নিশ্চিতভাবে পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভয়াবহ শুচিবায়ুগ্রস্থ। কোনো একটা জিনিস হারানো গেলে সে পুরো ঘর উলটেপালটে খুঁজবে সেটা। অনেকটা ধারালো ঘ্রাণশক্তিওয়ালা পুলিশের কুকুরের মতো। এভাবে খুঁজতে খুঁজতেই শেহেরজাদের ফেলে আসা জিনিসগুলো সে নিঃসন্দেহে খুঁজে পাবে তার পুত্রধনের কামরায়। এসব কিছু বোঝার পরেও শেহেরজাদের পক্ষে সে টি-শার্ট ফেলে আসা সম্ভব হলো না। বিবেকবুদ্ধি অনুসরণ করার মতো অবস্থায় তার মন ছিল না তখন।

বরং সে চিন্তা করতে আরম্ভ করল, এ টি-শার্টটার বদলে কী রেখে আসা যায়। একটা প্যান্টি রেখে আসা সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে। তার পরনেরটা খুব সাধারণ, অপেক্ষাকৃত নতুন এবং ধোয়ার পর আজ সকালেই সে পরেছে এটা। তার জামাকাপড়ের একদম পেছনে সে লুকিয়ে রাখতে পারে প্যান্টিটা। এর চেয়ে ভালো আর কিছু কী আছে, রেখে আসার মতো? কিন্তু সে প্যান্টি খুলে দেখে, প্যান্টির নিচের দিকটা এর মধ্যেই ভিজে গেছে। মনে হয় যৌন উত্তেজনা থেকেই এসব বেরিয়েছে, সে ভাবে। শুঁকে দেখল, ওতে কোনো বিশেষ রকমের গন্ধ নেই। তবুও, তার কামনার দাগসম্পন্ন একটা জিনিস ঐ রুমে রেখে আসতে শেহেরজাদের দ্বিধা হচ্ছিল। এতে করে শেহেরজাদের নিজেকে নামিয়ে ফেলা হবে ওর চোখে। আবারও সেটা পরিধান করে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে বসল সে—কী রেখে আসা যায় ওর জন্য? কী হতে পারে সেটা?

শেহেরজাদ তার গল্প থামিয়ে দিল। দীর্ঘক্ষণ ধরে সে নীরব, নিশ্চুপ হয়ে রইল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে স্রেফ শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজটা চালিয়ে যেতে থাকল। হাবারাও তার পাশে শুয়ে রইল চুপচাপ, শেহেরজাদের গল্প পুনরায় শুরু হবার অপেক্ষায়।

বেশ খানিকক্ষণ পর শেহেরজাদ চোখ খুলে বলল, “হেই, মিস্টার হাবারা!” এই প্রথম এমন অদ্ভুত এক সম্ভাষণে হাবারাকে ডাকল সে।

“কী মনে হয় তোমার, আমরা আরেকবার কাজটা করতে পারি?”

“উমম, মনে হয় পারা যাবে,” হাবারা জবাব দিল।

তারপর তারা আরও একবার সংগমে লিপ্ত হলো। এবার অবশ্য শেহেরজাদের দেহভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। হাবারার তার ভেতরে প্রবেশের মুহূর্তেই সে ছিল ভেজা, নরম এবং উষ্ণ। ত্বক ছিল টানটান। জেল্লা ছড়াচ্ছিল তার শরীর জুড়ে। হাবারা অনুমান করল, তাদের এই সংগমের মুহূর্তে শেহেরজাদ সমস্ত মন জুড়ে আছে অতীতে তার প্রেমিকের বাড়িতে অনুপ্রবেশের ঘটনা। যে স্মৃতি ছিল তার মনে খুবই স্পষ্ট। অথবা, কে জানে, হয়তো তা আসলে স্মৃতি ছিল না, সে সত্যি সত্যিই ফিরে গিয়েছিল তার সতেরো বছর বয়সের সেই দিনগুলোতে। শেহেরজাদের হয়তো এই জাদুকরি ক্ষমতা আছে। তার সম্মোহনী শক্তি দিয়ে বলা গল্পকে সে হয়তো বাস্তবে পরিণত করে ফেলতে পারে তার ক্ষেত্রে। একজন দক্ষ সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন জাদুকরের পক্ষে যেমন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকেই সম্মোহিত করে ফেলা সম্ভব।

এবারে তারা দুজন এমনভাবে সংগমে লিপ্ত হলো যার কোনো তুলনা ছিল না। এবারের সংগম ছিল একই সঙ্গে রাফ, তথা দয়ামায়াহীন, আবার আবেগি এবং লম্বা সময়ের। শেহেরজাদের চরম পুলকের মুহূর্তটিতে কোনো ভণিতা ছিল না। তার শরীর বেশ কয়েকবার থেমে থেমে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে সজোরে। শরীরের ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারার আমূল পালটে যায়। দেখতে ভিন্ন লাগছিল তাকে। আর হাবারা যেন দেয়ালের মাঝের ফোঁকরে চোখ রেখে তারুণ্যের শেহেরজাদকে আবিষ্কার করছিল এ সংগমের মাধ্যমে। হাবারার বাহুবন্ধনে ছিল যেন সতেরো বছর বয়স্ক এক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকা কিশোরী, যে কীভাবে কীভাবে যেন আটকা পড়ে গেছে এক পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক গৃহিণীর শরীরে। এ অনুভূতির ব্যাপারে হাবারার কোনো দ্বিধা ছিল না মনে। সে স্পষ্ট অনুভব করছিল সেই শেহেরজাদকে, সেই কিশোরীকে, যে প্রেমিকের বিছানায় শুয়ে পাগলের মতো ঘ্রাণ নিচ্ছিল প্রেমিকের ঘামে ভেজা টি-শার্টের।

এবার সংগমের পর শেহেরজাদ আর তাকে কোনো গল্প শোনাল না। তার কনডমের উপাদানও পরীক্ষা করে দেখল না। তারা পরস্পর পাশাপাশি, চুপচাপ শুয়ে রইল কোনো বাক্য বিনিময় ছাড়া। চোখ টানটান খোলা রেখে সে তাকিয়ে রইল ছাদের দিকে। যেন এক ল্যাম্প্রে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের ওপরিভাগে পানিতে প্রতিফলিত রোদের প্রতিচ্ছবির প্রতি। হাবারা ভাবল, কী অসাধারণ হতো ব্যাপারটা তার জন্যেও, যদি সে তার এই নবুতাকা হাবারা নামের একক ও অবিচ্ছিন্ন পরিচয়টি ত্যাগ করে অন্য কোথাও, অন্য কোনাে জগতে স্রেফ একটা ল্যাম্প্রে প্রজাতির ইল মাছ হয়ে ভেসে থাকতে পারত! সে নিজেকে আর শেহেরজাদকে তার কল্পনায় পাশাপাশি আবিষ্কার করল, দুজনই নিজ নিজ চোষক দিয়ে শক্ত করে চুষে ধরে রেখেছে নিচের এক পাথর, তাদের শরীর পানির স্রোতের টানে দুলছে; তারা ভেসে ভেসে অপেক্ষা করছে তাদের আশপাশ দিয়ে ঢিলেঢালা, বোকাসোকা, মোটাসোটা কোনো ট্রাউট মাছ ভেসে যাবার।

“টি-শার্টের বদলে কী রেখে এসেছিলে তুমি?” হাবারা অবশেষে কথা বলে।

কিন্তু শেহেরজাদ হুট করে কোনো উত্তর দেয় না।

“কিছুই না,” বেশ খানিকটা সময় নিয়ে বলে সে। “ওর ঘামে ভেজা, ওর গন্ধযুক্ত টি-শার্টের বিনিময়ে রেখে আসবার মতো কিছুই ছিল না আমার কাছে। কাজেই আমি ওটা স্রেফ ব্যাগে ভরে চলে এসেছিলাম। ঐ দিনই আমি একজন নিখাদ, বিশুদ্ধ চোরে পরিণত হই।”

***

বারো দিন পর শেহেরজাদ যখন চতুর্থবারের মতো সেই ছেলের বাড়ির দরজায় গিয়ে হাজির হয়, তখন সে আবিষ্কার করে যে দরজায় নতুন তালা লাগানো। সে তালার গায়ের স্বর্ণালি আভা সূর্যের আলোতে ঠিকরে উঠে যেন গর্বভরে নিজের অনতিক্রম্যতা ঘোষণা করছিল এবং এবারে আর পাপোশের নিচে কোনো চাবি রাখা ছিল না। নিশ্চয়ই সেদিন টি-শার্ট হারিয়ে যাবার পর তার মায়ের সন্দেহ ঘনীভূত হয়েছে। পুরো ঘর আঁতিপাঁতি করে খুঁজে তিনি তার সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা ঘরের মধ্যে কিছু অসংলগ্নতা খুঁজে পেয়েছেন। ধারণা করেছেন, তাদের সকলের অনুপস্থিতিতে তাদের ঘরে কেউ অনুপ্রবেশ করে। তারপর, খুব শীঘ্রই তার ধারণা অনুবর্তী হয়ে তিনি দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছেন। বদলে ফেলেছেন ঘরে প্রবেশ করবার তালা।

পুরো ব্যাপারটা আবিষ্কার করে শেহেরজাদ যেমন একদিকে হতাশ হয়ে ওঠে, অপরদিকে তার ভেতরে এক স্বস্তির সুবাতাস বইতে আরম্ভ করে। যেন কেউ তার পিছে এসে দাঁড়িয়ে কাঁধের ওপরে চেপে থাকা খুব ভারী এক বোঝা নামিয়ে দিয়েছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। তাহলে আমার আর ওর ঘরে ঢোকা হচ্ছে না, সে ভাবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, যদি এই বাড়ির তালা বদলানো না হতো, তবে সে বারবার ফিরে আসত এখানে এবং প্রতিবারই তার কিছু একটা ব্যাগে ভরে নিয়ে যাওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পেত আগেরবারের চেয়ে। এভাবে ধীরে ধীরে বড়সড় এক দুর্ঘটনার দিকে এগিয়ে যেত সে। হয়তো শেহেরজাদ দ্বিতীয়তলায় থাকার সময়েই পরিবারের কেউ চলে আসত হুট করে। তখন আর পালানোর কোনো সুযোগ থাকত না। তখন সে তার এই কর্মকাণ্ডকে কোনোভাবেই ব্যাখ্যা করতে পারত না কারও কাছে। এই ভবিষ্যৎই তার জন্য অপেক্ষা করেছিল আগামীকাল হোক বা দুদিন পরে হোক এবং ফলাফলে তার পুরো জীবন হয়তো ওলটপালট হয়ে যেত। সে কোনোমতে বেঁচে গেছে এ যাত্রা। যদিও ছেলেটার মায়ের সঙ্গে শেহেরজাদের কখনো দেখা হয়নি, তার ঈগল পাখির মতো চোখের জন্য শেহেরজাদ তাকে মনে মনে ধন্যবাদই দেয়।

প্রতিরাতে ঘুমোতে যাবার আগে শেহেরজাদ ছেলেটার সে ঘর্মাক্ত টি-শার্টের ঘ্রাণ শুঁকত বুকভরে। ঘুমানোর সময় টি-শার্টটাকে রাখত বিছানায়, ঠিক তার পাশে। সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে সে ওটাকে একটা কাগজে মুড়িয়ে রেখে দিত, পাছে যদি তা কারও চোখে পড়ে! তারপর, রাতের খাবার শেষে সে সেটাকে আবার বের করে আনত ছেনে ছুঁয়ে দেখতে, ঘ্রাণ নিতে। সে মনে মনে বেশ দুশ্চিন্তায় ভুগত যে, একদিন হয়তো টি-শার্টটা থেকে ছেলেটার শরীরের ঘ্রাণ উবে যাবে। কিন্তু সেটা সহসা ঘটেনি। যেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তির অমর স্মৃতির মতো ছেলেটার ঘামের গন্ধ লেগে রইল সেই টি-শার্টের গায়ে।

তারপর, একপেশে প্রেমিকের জনশূন্য বাড়ির তালা খুলে ঢুকবার সম্ভাবনা পুরোপুরি বাতিল হয়ে যাবার পর শেহেরজাদের মস্তিষ্ক আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে ধীরে ধীরে। ক্লাসের মধ্যে বসে তার দিবাস্বপ্ন দেখবার প্রবণতাও কমে যায়, শিক্ষকদের লেকচারেও তার মনোযোগ ফিরে আসে পুনরায়। যদিও তার চোখ আটকে থাকত ডায়াসে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে থাকা শ্রেণিশিক্ষকের দিকে নয়, বরং সামনে চেয়ারে বসে থাকা সে ছেলেটার দিকেই। শেহেরজাদ যেন তার চোখকে প্রশিক্ষণ দিয়ে রেখেছিল, সংগোপনে সবসময় ছেলেটাকে অনুসরণ করার জন্য, তার মাঝে সামান্যতম পরিবর্তন ঘটলেও সেটা লক্ষ করবার জন্য। যেমন, ছেলেটাকে কোনো কারণে খানিকটা নার্ভাস দেখালেও সেটা শেহেরজাদের চোখ এড়াত না। কিন্তু বাস্তবিকভাবে ওর ব্যবহারে আসলে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যেত না কখনো। হাসির কোনো উপলক্ষ্য এসে হাজির হলে সে হাসত মাথা ঝাঁকিয়ে আর প্রাণ খুলে, অপরদিকে তাকে যেকোনো প্রশ্ন করা হলেই সে প্রতিবারই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিত। আগের মতোই সে ফুটবল মাঠে গলা ছেড়ে চিৎকার করত। আগের মতোই খেলতে খেলতে সে ঘেমে নেয়ে উঠত। এক সাধারণ তরুণের স্বাভাবিক অস্তিমানতার অনুবর্তী নিত্যদিনের যে রুটিনমাফিক কাজকর্ম, তাতে কোনো ব্যত্যয় ধরা পড়েনি শেহেরজাদের চোখে।

তবুও, ছেলেটির চরিত্রের এক অন্ধকার, ছায়াঘেরা দিক শেহেরজাদের জানা ছিল, যা আর কারও জানা থাকার কথা না (ওর মার কথা অবশ্য ভিন্ন)। তৃতীয়বার তাদের ঘরে প্রবেশের সময় ছেলেটার কাপড় রাখার ক্লজেটের একদম গভীর অতলে কিছু পর্নগ্রাফিক পত্রিকা খুঁজে পেয়েছিল শেহেরজাদ। সে সমস্ত পত্রিকা নগ্ন নারীদেহের ছবিতে ভর্তি ছিল, যারা সবাই দুদিকে পা ছড়িয়ে দিয়ে সোজাসাপটাভাবে তাদের যৌনাঙ্গসমূহ প্রদর্শন করছিল। কিছু ছবি ছিল সংগমের দৃশ্য, যাতে অসম্ভব, অবাস্তব সব ভঙ্গিতে পুরুষরা তাদের লোহার রডের মতো পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করছিল নারীদের যোনিপথে। এর আগে শেহেরজাদ কখনো এ ধরনের পর্নগ্রাফিক ছবি দেখেনি। সে ছেলেটার ডেস্কে বসে গভীর মনোযোগ সহকারে প্রতিটি ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছিল সময় নিয়ে। তার ধারণা হয়েছিল যে, ছেলেটা ছবিগুলো দেখতে দেখতে হস্তমৈথুন করে। কিন্তু এর কারণে তাকে ছেলেটাকে খারাপ মনে হয়নি। আর ছবি দেখে হস্তমৈথুন করাটাও তার কাছ খুব অস্বাভাবিক কোনো কাজ লাগেনি। শেহেরজাদের কাছে ছেলেদের হস্তমৈথুন ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক মনে হতো। অণ্ডকোষে জমা হওয়া এত এত বীর্যের কোনো না কোনো সূত্রে তো বেরিয়ে আসারই কথা, মেয়েদের অব্যবহৃত ডিম্বাণু যেমন কিনা বেরিয়ে আসে মাসিকের রক্তে। একটা সাধারণ কিশোরের তো এমনই হবার কথা। ছেলেটা কোনো মুনিঋষি নয়, নয় কোনো মহাপুরুষ। বরং ওর চরিত্রের এদিকটা আবিষ্কার করে শেহেরজাদ যেন খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

“ওর বাড়িতে প্রবেশের সুযোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমার ওকে নিয়ে পাগলামো আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করে। সমুদ্রের স্রোতে যেমন খুব ধীরে ভাটা পড়ে, তেমনি। আস্তে আস্তে আবিষ্কার করলাম, ওর গেঞ্জিও আর তেমন একটা শোঁকা হচ্ছে না প্রতিনিয়ত বা ওর পেনসিল আর ব্যাজ নিয়েও তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করছি না প্রতিদিন। এ যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো এক ব্যাপার। রূপক অর্থে জ্বরের কথা বললেও, আসলে কিন্তু আমার ঐ অবস্থাটা প্রায় অসুস্থতার পর্যায়েই ছিল। ঐ অবস্থায় আমি কোনো কিছু নিয়েই স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করতে পারতাম না। হয়তো সবার জীবনেই এমন একটা পাগলাটে সময়কাল আসে এক-আধবার। অথবা হয়তো কেবল আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছিল এটা। তোমার এমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে?”

হাবারা শেহেরজাদের প্রশ্নের উত্তরে চিন্তা করে বেশ কিছুক্ষণ, কিন্তু পুরো স্মৃতির পাতা আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও তার স্মরণ আসে না এমন কিছু। “নাহ, এত তীব্রভাবে কারও প্রেমে পড়ার ঘটনা মনে পড়ছে না আমার।” পরিশেষে সে বলে।

শেহেরজাদ তার উত্তরে কিছুটা দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হয়।

“যাই হোক, গ্রাজুয়েশন শেষ করবার পর আমি ওর কথা পুরোপুরি ভুলে যাই। এত দ্রুত, এত সহজে এই ভুলে যাবার ঘটনাটা ঘটে যে, ভাবতে অবাকই লাগে। ওর মধ্যে এমন কী ছিল যে সতেরো বছর বয়সে আমি ওর প্রতি এতটা তীব্রভাবে আকর্ষিত হয়েছিলাম? অনেক ভেবেচিন্তেও কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি কখনো। জীবন কী বিস্ময়কর, তাই না? কোনো একটা জিনিস হঠাৎই এত চকচকে উজ্জ্বলরূপে সামনে এসে হাজির হয় যে ওটাকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য আমরা সবকিছু ত্যাগ করার জন্যেও এককথায় প্রস্তুত হয়ে যাই। তারপর কিছু সময় অতিবাহিত হয়, দৃষ্টিভঙ্গি বদলায় খানিকটা, সঙ্গে সঙ্গে আমরা চমকে উঠে আবিষ্কার করি—সেই ঔজ্জ্বল্য কতখানি ফিকে হয়ে গেছে! কীসের মোহে পড়েছিলাম আমি—নিজেকে তখন প্রশ্ন করি আমরা। তো, এটাই হচ্ছে আমার ‘জনশূন্য ঘরে অনুপ্রবেশ’ সময়কালের গল্প।”

সে এমনভাবে সময়কাল শব্দটার ওপর জোর দিল, যেন শেহেরজাদ তালা খুলে জনশূন্য ঘরে চুরি করে ঢোকা নিয়ে, বরং কথা বলছে চিত্রকর পাবলো পিকাসোর শিল্পীজীবনের ‘ব্লু পিরিয়ড’ সময়কালটা নিয়ে।

তারপর সে হুট করে তাকাল বিছানার পাশে রাখা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে। তার চলে যাবার সময় ঘনিয়ে এসেছে। কিছু সময় ভারী নীরবতার দখলে চলে গেল।

“সত্যি বলতে, গল্পের শেষ আসলে এখানে নয়।” সে পরিশেষে বলে। “কয়েক বছর পর, যখন আমি আমার নার্সিং স্কুলের দ্বিতীয় বর্ষে ছিলাম, নিয়তি খুব অদ্ভুতভাবে আমাদের আবার কাছাকাছি টেনে নিয়ে আসে। তার মায়ের এক বড় ভূমিকা ছিল এতে, ঘটনাপ্রবাহ এমন অদ্ভুতভাবে ঘটতে থাকে যে চমকে যেতে হয়, এ যেন ঠিক সেই আগের দিনের ভৌতিক কোনো এক ঘটনা! তুমি কি শুনতে চাও সে কাহিনি?”

“অবশ্যই,” হাবারা উত্তর দেয়।

“পরেরবার এসে সে গল্প শুরু করব তাহলে,” শেহেরজাদ বলে। “শেষ করতে সময় লাগবে। এ মুহূর্তে আমার বাড়ি ফিরে গিয়ে রাতের খাবার রান্না করা দরকার।”

শেহেরজাদ উঠে বসে তার পোশাক পরে নিল একে একে—প্যান্টি, স্টকিংস, ক্যামিসোল, শেষমেশ তার স্কার্ট এবং ব্লাউজ। হাবারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে পোশাক পরিধানে ব্যস্ত শেহেরজাদের শরীরের ধারাবাহিক নড়াচড়া দেখল। দেখতে দেখতে হুট করে তার মনে হলো যে, মেয়েদের জামা খোলার চেয়ে জামা পরার কায়দা আরও বেশি ইন্টারেস্টিং।

“নির্দিষ্ট কোনো বই পড়তে চাও, যা নিয়ে আসব তোমার জন্য আগামীবার?” দরজা খুলে বাইরে বেরুতে গিয়ে শেহেরজাদ প্রশ্ন করে।

“না, বিশেষ কোনো বইয়ের প্রয়োজন নেই,” হাবারা উত্তর দেয়। তার সত্যি সত্যিই যেটা প্রয়োজন, তা হলো শেহেরজাদের গল্পের বাকি অংশ। কিন্তু এ কথাটা সে মুখ ফুটে বলে না। তার ভয় হয়, তাহলে হয়তো সে গল্প তার আর কখনো শোনা হবে না।

হাবারা সে রাতে আগেভাগেই শুয়ে পড়ল বিছানায়। তারপর সে চিন্তা করা আরম্ভ করল শেহেরজাদকে নিয়ে। আসলেই এমনটা হতে পারে যে, ওর সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না তার। এই চিন্তা হাবারাকে অস্থির করে তোলে ভেতরে ভেতরে। খুবই বাস্তব এ সম্ভবনা। তাদের দুজনের মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কোনো সম্পর্ক নেই—বিয়ে বা প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকবার মতো কোনো প্রতিজ্ঞা বা কোনো পারস্পারিক বোঝাপড়া, এমন কিছু, যা তাদেরকে আটকে রাখবে একে অপরের সঙ্গে। তাদের এই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে অন্য কারও ইশারায়, তার ইশারায় আবার সে সম্পর্ক টুটেও যেতে পারে। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, তাদের মধ্যের বন্ধনটা খুব সরু সুতোয় বাঁধা। সম্ভবত, না, সম্ভবত না, আসলে নিশ্চিতভাবেই কোনো না কোনোদিন তাদের এই সুতোর বাঁধন ছিঁড়ে যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনাটা কি শীঘ্রই ঘটতে চলেছে, না আরও কিছুদিন পর। শেহেরজাদ চলে গেলে আর এ সমস্ত গল্প শোনা যাবে না। একবার এই স্রোতে বাঁধা পড়লে সমস্ত অদ্ভুত এবং অজানা গল্পগুলো শেহেরজাদের সঙ্গেই উধাও হয়ে যাবে।

তবে, ভিন্ন আরেক সম্ভাবনাও আছে। এ ক্ষেত্রে হয়তো হাবারাকে তার স্বাধীনতা থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত করা হবে, তখন কেবল শেহেরজাদ নয়, নারীসঙ্গই হাবারার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যাবে সম্পূর্ণভাবে। এটাও খুব বাস্তব এক সম্ভাবনা। সে ক্ষেত্রে হাবারার পক্ষে আর কখনো কোনো নারীর নরম শরীর ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। চরম পুলকের মুহূর্তে থিরবিজুরির মতো কোনো নারীশরীর কেঁপে কেঁপে ওঠা প্রত্যক্ষ করারও সুযোগ হবে না হাবারার। সংগমের সুযোগ হারানোর চেয়েও হাবারার জন্য আরও কষ্ট হবে সংগমের পর আয়েশি ভঙ্গিতে গল্পগুজব করে কাটানোর নিমিত্তে যে নারীসঙ্গ—তা থেকে বঞ্চিত হওয়া। নারীসঙ্গের ব্যাপারটা তার জন্য ছিল একদিকে বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করার সুযোগ, অপরদিকে বাস্তবতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করার মতো এক ব্যাপার। আর শেহেরজাদের সঙ্গে থাকলে এই দ্বৈততা বিমূর্ততার প্রেক্ষাপট এড়িয়ে সম্পূর্ণ মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। সত্যিই, এ ব্যাপারে শেহেরজাদের দক্ষতা অসামান্য। শেহেরজাদকে হারিয়ে ফেলার কথা চিন্তা করলেই হাবারার মন অতুলনীয় দুঃখে ভরে ওঠে।

হাবারা চোখ বন্ধ করে শেহেরজাদের চিন্তাকে মাথা থেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করে। বরং, সে ল্যাম্প্রের কথা ভাবে। চিন্তা করে চোয়ালবিহীন ল্যাম্প্রের কথা, যে নিজের চোষক দিয়ে নদীর নিচের কোনো পাথরের সঙ্গে নিজেকে আটকে রেখে মৃদু দুলছে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে। হাবারা নিজেকে এক ল্যাম্প্রে হিসেবে কল্পনা করে। ওভাবে পানির নিচে দুলতে দুলতে সে অপেক্ষা করে আশপাশ দিয়ে এক পেটমোটা, বোকাসোকা ট্রাউট মাছের ভেসে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে যতই অপেক্ষা করুক, কোনো ট্রাউট মাছের দেখা মেলে না। না মোটা, না সরু, কোনো ট্রাউট মাছেরই দেখা পাওয়া যায় না। এভাবেই একসময় সূর্য ডুবে যায়, হাবারার চারপাশ ছেয়ে যায় নিকষ কালো আঁধারে।

হারুকি মুরাকামির ইংরেজিতে অনূদিত গল্পগ্রন্থ ‘মেন উইদাউট ওমেন’-এর ‘পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউজ ইউকে’ সংস্করণে টেড গোসেনকৃত ইংরেজি অনুবাদের বঙ্গানুবাদ

You may also like

Leave a Comment

Muktochinta

Multochinta is a famous news media from New York. 

Subscribe my Newsletter for new blog posts, tips & new photos. Let's stay updated!

All Right Reserved. 2022 emuktochinta.com