১১৩
অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে ভূমিকা রাখা প্রয়োজন সেটি করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক - এমনটা মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে 'অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতার' পরিচয় দিচ্ছে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিউইয়র্ক -ভিত্তিক গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন সম্প্রতি একটি র্যাংকিং প্রকাশ করেছে যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণরকে 'ডি গ্রেড' দেয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর মাধ্যমে বোঝা যায় বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভালো অবস্থানে নেই। বিবিসি বাংলা। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়া, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতির দিকে, ডলার সংকট এবং ডলারের বিপরীতে টাকার ধারাবাহিক দরপতন- এসব পরিস্থিতি অর্থনীতিকে জটিল করে তুলেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন মূল্যস্ফীতি কমানো, মুদ্রার বিনিময় হারে স্থিতিশীলতা আনা এবং খেলাপি ঋণ কমানো- এ তিনটি বিষয় ব্যাংকিং সেক্টর ও দেশের অর্থনীতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক 'অদক্ষতা কিংবা ব্যর্থতার' পরিচয় দিয়েছে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। এ পরিস্থিতির জন্য 'রাজনৈতিক চাপ ও সরকারের নিয়ন্ত্রণ' বড় ভূমিকা পালন করেছে বলেও মনে করেন তারা। টাকা ছাপানো নিয়ে উদ্বেগ বাংলাদেশে অনেক দিন ধরেই বাজারে ডলারের তীব্র সংকট তৈরি হয়ে আছে এবং কোনভাবেই বৈদেশিক মুদ্রার ক্ষেত্রে বাজারে স্থিতিশীলতা আনা যাচ্ছে না। আবার ডলারের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখনকার যে নীতি সেটি রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করছে বলেও মনে করেন অনেকে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট-এর নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলছেন, বিনিময় হার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটানা বার বছর বসেছিল এবং কোন পরিবর্তন না আনায় একটা সংকট তৈরি হয়েছে। “আবার ইচ্ছে মতো টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেয়ার কারণেও বড় ধরণের চাপ তৈরি হয়েছে। আবার ব্যাংকিং খাতে রেকর্ড পরিমাণ নন-পারফরমিং লোন। রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ ও ব্যাংকের অনুমোদন। এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক ম্যানেজ করতে পারেনি ও পারছে না,” বলছিলেন তিনি। বাজারে ডলারের মূল্য নির্ধারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর ও স্থিতিশীল কোন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন ডলারের মূল্য যেভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সেটা বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা পৃথিবীর অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাফল্য দেখালেও বাংলাদেশ সেটা পারছে না। সরকারি হিসেবে অগাস্ট মাসে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ছিলো প্রায় ১০ শতাংশ। তবে শুধু খাদ্য মূল্যস্ফীতি আলাদা করলে এর হার ১২.৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরি বলেছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেমন সফলতা পায়নি, তেমনি নিজেদের ঘোষিত মুদ্রানীতি বাস্তবায়নেও তারা সাফল্য পায়নি। মুস্তফা কে মুজেরি বলছেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিন্তা করা উচিত যাতে তাদের নীতিটা বাজার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়”। “মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে ও যে মুদ্রানীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষণা করেছে সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যা আছে তা দূর করার ক্ষেত্রে অদক্ষতা আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সেদিকে নজর দেয়া উচিত। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও রিজার্ভ ক্রমাগত সংকুচিত হচ্ছে- এসব বিষয়ে যে নীতিগুলো এখন অনুসরণ করছে সেগুলোতে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন,” বলছিলেন মি. মুজেরি। 'সিদ্ধান্ত আসে রাজনৈতিক দিক থেকে' ব্যাংকগুলোতে নানাবিধ সংকটের চিত্র প্রকাশ পাচ্ছে গণমাধ্যমে। ব্যাংক খাতের এ দুরবস্থা নিয়ে কখনোই কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মি. মুজেরি মনে করেন, ব্যাংক খাতকে তদারকিতে রাখার ক্ষেত্রে সফল হতে পারছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং একই সাথে মুদ্রানীতিতে যেসব নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নেও সফলতা নেই তাদের। “মুদ্রানীতিতে অনেক ভালো কথা বলা হয়েছে কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কিংবা বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়ে সঠিক মনিটরিং নেই। নীতিগুলো কাগজেই রয়ে যাচ্ছে”। যদিও আহসান এইচ মনসুর মনে করেন ব্যাংকিং খাতসহ অনেক বিষয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। “অনেক সিদ্ধান্ত আসে রাজনৈতিক দিক থেকে। এজন্য গভর্নরকে দোষ দেয়া সঠিক হবে না। বরং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই স্বাধীনতাই নেই। সে কারণে পেশাদারিত্বও তৈরি হয়নি,” বলছিলেন তিনি। তার মতে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অদক্ষতার মূলেই রাজনৈতিক চাপ এবং এটি সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এর সাফল্য ব্যর্থতা নির্ভর করে মনিটরিং বিষয়ে সরকারের পলিসি কতটা ভালো-তার ওপর। ব্যর্থতার আরও যত জায়গা বাংলাদেশের রিজার্ভ এখন সবার জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে আর আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যে ইঙ্গিত দিচ্ছে তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ রিজার্ভ বিশ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে নেমে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত কয়েক মাসে কমেছে এবং এর জের ধরে ব্যাংকে সঞ্চয় কমে গেছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ক্ষেত্রেও। আহসান এইচ মনসুর বলছিলেন, “রাজস্ব বাড়ছে না- কমে যাচ্ছে। রেমিট্যান্স আসছে না ও বাড়ছে না রিজার্ভ। আবার রাজনৈতিক কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক কাজ করতে পারেনি। তবে তার মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বড় অদক্ষতা হলো সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারা। “এর মধ্যে টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ধার দেয়া হয়েছে বলে আরও চাপ তৈরি হয়েছে। এগুলোতে যথাযথ সমন্বয় ছিলো না। ফলে এর খেসারত দিতে হবে সবাইকে,” বলছিলেন মি. মনসুর। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তিন টার্গেট বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো সবার কাছে যথাযথ নাও মনে হতে পারে, কিন্তু পরিস্থিতি ও বাস্তবতা বিবেচনা নিয়েই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়ন করেছে। “এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের নীতি ও করনীয় সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করছেন -যার মূল্য লক্ষ্য হলো দ্রুত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা,” বলছিলেন তিনি। গ্লোবাল ফিন্যান্স ম্যাগাজিন তাদের প্রতিবেদনে মূলত বাংলাদেশের অর্থনীতির কাঠামোগত দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণকেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আর মূলত এসব দুর্বলতার কারণেই গভর্নর হিসেবে আব্দুর রউফ তালুকদারকে ম্যাগাজিনটি ‘ডি গ্রেডে’ রেখেছে। এর আগে ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ‘সি গ্রেড’-এ ছিলেন। ২০১৫ সালে ‘বি মাইনাস’ গ্রেডেও উন্নীত হয়েছিলেন তখনকার গভর্নর আতিউর রহমান। পরে আট কোটি ডলার রিজার্ভ চুরির ঘটনার জের ধরে মি. রহমানকে পদত্যাগ করতে হয়েছিলো। এরপর দায়িত্ব নেয়া গভর্নর ফজলে কবির কখনো ‘বি’ কখনো ‘সি’ আবার কখনো ‘ডি’ গ্রেডভুক্ত হয়েছিলেন। মেজবাউল হক বলছেন, মনিটরিং পলিসি করার আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টদের মতামত নিয়েছিলো এবং এখন তারা আবার বিশেষজ্ঞদের সাথে বৈঠক করে বিশ্লেষণ করে দেখছেন কোথাও ব্যাংক ভুল করেছে কি-না কিংবা যে পথে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুচ্ছে সেটি আছে কি-না। তিনি জানিয়েছেন যে তিনটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন কাজ করছে- মূল্যস্ফীতি কমানো, এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীলতা এবং নন পারফরর্মিং লোন। “এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সাথে আমরা এখন মত বিনিময় করছি। তাদের পরামর্শ নিচ্ছি”। কিন্তু ব্যাংক কোথায় ব্যর্থ হলো কিংবা দক্ষতার অভাব ছিলো কোন কোন ক্ষেত্রে -এমন প্রশ্নের জবাবে মি. হক বলেন, “অর্থনীতিতে কোন সংকটের সরাসরি ঔষধ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব কিছু বিশ্লেষণ করে নীতি প্রণয়ন করে। সেটি কারও মতের সাথে মিলতে পারে আবার কারও সাথে নাও মিলতে পারে। যখন যেটি ভালো মনে হয় সেটিই করার চেষ্টা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক”। তবে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগ্রাধিকার হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা এবং সেটি নিয়েই কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে, গত ১৪ বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ৩২২ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ২০২৩ সালের জুনের শেষে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শুরুতে ২০০৯ সালের জুন মাসে ছিল ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১৪ বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩২২ শতাংশ বিদেশি ঋণ বাড়ার পেছনে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বিদেশী ঋণের উপর দেশটির ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ সাধারণত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং প্রধান বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের মতো বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ রিপোর্ট ২০২২ অনুসারে, ২০১১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ বছরে ভারতের বিদেশী ঋণ প্রায় ৮৩ শতাংশ, পাকিস্তানের ১০১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কার ১১৯ শতাংশ বেড়েছে। একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ২১৩ দশমিক ছয় শতাংশ।