নাজমুল আশরাফ
মাত্র চার বছরে অ্যামেরিকার রাজনীতি কতোটা বদলে গেছে! ২০১৭ সালের এই সময়ে অ্যালাবামার সেনেট আসন জয়ের পথে ছিলেন ডেমোক্র্যাটরা। গাঢ় লাল স্টেইট হওয়া সত্তে¡ও, সেখানে রিপাবলিকানরা তখন খুবই বেকায়দায় ছিলেন। ২০১৮ সালে ডেমোক্র্যাটরা যে সেনেটে বড় জয় পেতে যাচ্ছিলেন, তার অনেকগুলো ঈঙ্গিতের একটা ছিল অ্যালাবামা।
এখন সব কিছুই অন্যরকম। একেবারেই বিপরীত। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক জোয়ারের যতোগুলো সূচক ছিল, তার প্রত্যেকটি এখন ২০২২ মধ্যবর্তী নির্বাচনে রিপাবপলিকান জোয়ারের পক্ষে আছে। চার বছরের ব্যবধানে জয়ের যেসব সূচক নীল থেকে লাল হয়ে গেছে, এবার সেগুলো নিয়ে কথা বলবো।
হাউযের সাধারণ নির্বাচন
২০১৭ ডিসেম্বরের জরিপে, কংগ্রেসের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা প্রায় ৯ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে হাউয নির্বাচনে জেতার জন্য তাদের এই ব্যবধান দরকার ছিল। ২০২১ ডিসেম্বরের জরিপে, সাধারণ নির্বাচনে রিপাবলিকানরা গড়ে দুই পয়েন্টে এগিয়ে। ১৯৩৮ সাল থেকে মাত্র দুটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের এই পর্যায়ে রিপাবলিকানরা এগিয়ে ছিলেন। তার একটি ছিল ২০০২ সালে, যখন রিপাবলিকানরা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইতিহাস পাল্টে দিয়ে হাউযের নিয়ন্ত্রণ নেন। ওই জয়ের প্রেক্ষিত ছিল নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলা এবং প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাবিøউ বুশের ব্যাপক জনপ্রিয়তা। আরেকটা ব্যতিক্রম ছিল ২০১০ সালে, যখন রিপাবলিকানরা এই পর্যায়ে সাধারণ নির্বাচনের হিসাবে দুই পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। তখন তারা ৬৩টি আসন বেশি পান। আসলে, মধ্যবর্তী নির্বাচনের এতোটা বাকি থাকতে, সাধারণ ভোটের জরিপে বিরোধী দলের (যে দল হোয়াইট হাউযের বাইরে) এগিয়ে থাকার ঘটনা, ১৯৩৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১০ বার ঘটেছে। ওই ১০ বারই মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরোধী দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে।
প্রেসিডেন্টের প্রতি জনসমর্থন
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রিপাবলিকানদের দুরবস্থার একটা বড় কারণ ছিল তখনকার প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের জনসমর্থন কমে যাওয়া। তখন তাঁর গড় জসমর্থন ছিল মাত্র ৩৭ শতাংশ। এটা ছিল কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রথম মেয়াদের ১১ মাসে সবচেয়ে কম জনসমর্থন।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অবস্থাও খুব একটা ভালো না। তাঁর জনসমর্থন ৪২ শতাংশের মতো। নির্বাচিত প্রেসিডেন্টদের প্রথমম মেয়াদের এই পর্যায়ে শুধুমাত্র ট্রাম্পই তাঁর নীচে। মধ্যবর্তী নির্বাচনের এতোটা সময় বাকি থাকতে, যেসব প্রেসিডেন্টের দলের হাউয আসনের কমা-বাড়া পাঁচের নীচে ছিল, তাদের কারো জনসমর্থনই এতোটা কম ছিল না। আর মাত্র ৫টা আসন পেলেই রিপাবলিকানরা হাউযের নিয়ন্ত্রণ পাবেন।
১৯৬২, ১৯৯৮ এবং ২০০২ মধ্যবর্তী নির্বাচনের এই পর্যায়ে প্রেসিডেন্টদের জনসমর্থন ছিল ৬০ থেকে ৮৪ শতাংশের মধ্যে।ওই তিনবারই প্রেসিডেন্টের দলের আসন কমা-বাড়া পাঁচের নীচে ছিল।
বিশেষ নির্বাচন ও ভার্জিনিয়া
২০১৭ সাল থেকে জরিপের পাশাপাশি বিশেষ নির্বাচনগুলোতেও খুবই জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প আমলের এই পর্যায়ে, স্টেইট অ্যাসেম্বলি ও কংগ্রেসের ৭০টিরও বেশি বিশেষ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থীরা ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একই সময়ের চেয়ে ওইসব স্টেইট বা ডিস্ট্রিক্টে গড়ে ১০ পয়েন্টের মতো এগিয়ে ছিলেন।
বাইডেন আমলে অনুষ্ঠিত স্টেইট অ্যাসেম্বলি ও কংগ্রেসের ৬০টি বিশেষ নির্বাচনে রিপাবলিকানরা ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তুলনায় গড়ে ৫ শতাংশের মতো এগিয়ে গেছেন। আগামী মধ্যবর্তী নির্বাচনের এখনো ৯ মাসেরও বেশি বাকি থাকলেও, বিশেষ নির্বাচনে প্রেসিডেন্টের জনপ্রিয়তায় পরিবর্তনের ভিত্তিতেই পরের নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ধারণা করা হয়ে থাকে। ১৯৯৪ সাল থেকে সব মধ্যবর্তী নির্বাচনের ক্ষেত্রেই এটা সত্যি হয়ে আসছে। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যে জনসমর্থন ছিল, ২০২০ নির্বাচনের আগের বিশেষ নির্বাচনগুলোতে তার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয় নাই অর্থাৎ রিপাবলিকানরা তেমন একটা সমস্যায় নাই এমন কিছু জরিপ তাদের জন্য ছিল একটা বড় বিপদ সংকেত। বিশেষ নির্বাচনগুলো ছাড়াও, ২০১৭ সালে ভার্জিনিয়ার নিয়মিত নির্বাচনগুলোতে ডেমোক্র্যাটরা ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে ৩.৫ পয়েন্টে এগিয়ে ছিলেন। একই অবস্থা ছিল গভর্নর এবং ১০০টি হাউয অব ডেলেগেইট নির্বাচনেও।
গত মাসে, রিপাবলিকানরা গভর্নর নির্বাচন এবং ১০০টি হাউয অব ডেলেগেইট নির্বাচনে ২০২০ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে ১২ পয়েন্টের বেশি এগিয়ে ছিলেন। এরফলে তারা গভর্নর, লুটেন্যান্ট গভর্নর এবং এটর্নি জেনারেল পদে জিতে হাউয অব ডেলেগেইটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন।
হাউযে অবসরের ঘোষণা
রাজনীতিবিদদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নির্বাচন ও জরিপের ফলাফল একটা বড় ভূমিকা রাখে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন এক ডযনেরও বেশি হাউয রিপাবলিকান। তখন ডেমোক্র্যাটদের এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন।
চার বছর পর এই অবস্থা পাল্টে গেছে। বর্তমান কংগ্রেসের মেয়াদ শেষে অবসরে যাচ্ছেন ১১ জন হাউয ডেমোক্র্যাট। রিপাবলিকানদের এই সংখ্যা মাত্র ৪। অন্যান্য নির্বাচনে অংশ নিলেও হাউয ছাড়তে যাওয়া ডেমোক্র্যাটের সংখ্যা এখন ১৯ এবং রিপাবলিকান ১১। অথচ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে কংগ্রেস থেকে অবসরে যাওয়া রিপাবলিকান ছিলেন ২৩ জন।
অবসরে যাওয়ার ঘটনা ভবিষ্যত মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলের একমাত্র ইঙ্গিত না হলেও, এটা একটা বড় ইঙ্গিত। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও এসব পরিসংখ্যান বিবেচনা করছেন। হেরে যাবার আশংকা না করলে তারা হয়তো গণহারে অবসরে যেতেন না। এই কারণেই যে দলের সবচেয়ে বেশি নির্বাচিত প্রতিনিধি অবসরে গেছেন, সে দলই গত ১২টি মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্যে ৮টিতেই হেরে গেছে। ১৮৭০ সাল থেকে ৩৮টি মধ্যবর্তী নির্বাচনের মধ্যে ৩৪ টিতেই বিরোধী দলের আসন বেড়েছে ৫টি বা তারচেয়েও বেশি। ২০২২ মধ্যবর্তী নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম হওয়ার মতো খুব একটা লক্ষণ নাই। কমপক্ষে ৫টি আসন বাড়লেই রিপাবলিকানরা হাউযের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবেন।
ক্যাপটল হিলে হামলার বিচার
তবে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক এই হিসাব বদলে দিতে পারে ক্যাপিটল হিলে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। ওই হামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত যা কিছু বেরিয়ে এসেছে এবং সামনে আরো যা কিছু বেরিয়ে আসবে, তার সবই রিপাবলিকানদের বিরুদ্ধে যাবে। ওই হামলার পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের জড়িত থাকার অনেক তথ্য-প্রমাণই পেয়েছে হাউয সিলেক্ট কমিটি। রিপাবলিকানরা এই তদন্তে সহযোগিতা না করে এবং তদন্তে পাওয়া সব কিছুই অস্বীকার করার মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতাই বাড়িয়েছেন। মধ্যবর্তী নির্বাচনেও হাউয ও সেনেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে এই তদন্তই ডেমোক্র্যাটদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কিন্তু তদন্তের গতি যতোই বাড়ানো হোক, নভেম্বরের মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে দায়ীদের দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হবে না। তবে তদন্ত শেষে দায়ীদের অভিযুক্ত করে বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারলেও, মধ্যবর্তী নির্বাচনে এর যথেষ্ট প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে তদন্ত ও বিচারের স্বচ্ছতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা একটা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, রিপাবলিকান নেতৃত্বের পাশাপাশি এই দলের কর্মী-সমর্থকদের একটা বড় অংশ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা কোনো অভিযোগই বিশ্বাস করে না। ফলে ট্রাম্পের অন্ধ ভক্তদের ওপর ক্যাপিটলে হামলার তদন্ত, বিচার, এমনকি রায়েরও কোনো প্রভাব পড়বে না। #
ক্যাপিটল হিলে হামলার বিচারই পারে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ইতিহাস পাল্টে দিতে
৩১৩
previous post