হরমোনভিত্তিক জন্মনিরোধ পদ্ধতি বা হরমোনাল পিল ব্যবহার জন্মনিয়ন্ত্রণে বহুল ব্যবহৃত একটি পদ্ধতি। ব্রিটেনে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা নারীদের অনেকে এখন এই বড়ি খাওয়া ছেড়ে দিয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণের জন্য প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন।
প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছেন বলতে মূলত বোঝানো হচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে তারা একটি মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছেন। অ্যাপটির নাম ন্যাচারাল সাইকেলস। এই অ্যাপটি ২০১৩ সালে চালু করা হয় এবং বর্তমানে এর নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনও ২০১৮ সালে ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপটিকে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। জন্মনিয়ন্ত্রণের বিষয়ে এটিই প্রথম অ্যাপ যা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পেয়েছে।
অ্যাপটি যারা তৈরি করেছেন তারা বলছেন সন্তানধারণের জন্য একজন নারী কখন সবচেয়ে বেশি উর্বর থাকে এই অ্যাপটির অ্যালগরিদম তা নির্ধারণ করতে পারে।
শরীরের তাপমাত্রা পরিমাপ করে এটি করা হয়। তারা দাবি করছেন এই অ্যাপের সাফল্যের হার ৯৩ শতাংশ। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ির স্বাভাবিক ব্যবহারেও একই ধরনের সাফল্য পাওয়া যায়।
এই অ্যাপটির পেছনে যে ধারণা কাজ করছে তা হলো – প্রচলিত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিকল্প ব্যবস্থা তুলে ধরা। এই পদ্ধতিতে হিসাব নিকাশ করে বলে দেওয়া হয় একজন নারীর কখন অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। অর্থাৎ তখন তিনি সবচেয়ে বেশি উর্বর থাকেন। এই বিষয়টি নির্ভর করে একেকজন নারীর ঋতুস্রাব সংক্রান্ত চক্রের ধরনের ওপর।
তবে এই অ্যাপের ব্যাপারে অভিযোগও উঠেছে। কোনো কোনো নারী বলেছেন যে অ্যাপটি ব্যবহার করেও তারা গর্ভবতী হয়ে পড়েছেন।
ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সব ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যাপারে একটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে পদ্ধতিটি সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না। এর উপরেই কার্যকারিতা নির্ভর করে। গর্ভধারণ ঠেকাতে কোনো পদ্ধতিই শতভাগ সফল নয়, এমনকি সঠিক উপায়ে ব্যবহার করেও।
তবে তিনি বলেন, এর কার্যকারিতা অন্য যেকোনো সচেতনতামূলক পদ্ধতির চেয়ে বেশি।
তবে যুক্তরাজ্যে বিজ্ঞাপনের মানের ওপর নজর রাখে যে কর্তৃপক্ষ তারা ২০১৮ সালে ফেসবুকে ন্যাচারাল সাইকেল অ্যাপটির বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করেছিল। কারণ ওই বিজ্ঞাপনে দাবি করা হয়েছিল যে অ্যাপটি ‘অত্যন্ত নির্ভুল’। কর্তৃপক্ষ তখন বিজ্ঞাপনটিকে বিভ্রান্তিকর বলে উল্লেখ করেছিল।
এ সত্ত্বেও ব্রিটেনের লাখ লাখ মানুষ এই অ্যাপটিকে ব্যবহার করে আসছে।
কিভাবে কাজ করছে
এপ্রিল ইন্সকিপ নামে এক নারী প্রায় এক দশক ধরে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। আগে তিনি হরমোনাল পিল ব্যবহার করতেন। তবে য়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে তিনি বুঝতে পারলেন যে শরীরের ওপর পিলের অনেক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, আমি অলস হয়ে গিয়েছিলাম। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকতো, ত্বক ফেটে যেতে লাগল।
এপ্রিল সকালে তার শরীরের তাপমাত্রা মেপে সেটা মোবাইল ফোনের একটি অ্যাপে রেকর্ড করে রাখেন। প্রতিদিনের এই ভার্চুয়াল চার্ট দেখে তিনি জানতে পারেন কোন সময়ে তার গর্ভধারণের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি এবং কখন সবচেয়ে কম থাকে।
তিনি বলেন, কোনো একটি অ্যাপের করা বিশ্লেষণের চেয়েও আমি পুরো চার্টটি দেখতে চাই। আমার আত্মবিশ্বাস আছে যে আমি আমার শরীরকে ভালো বুঝতে পারি এবং এই পদ্ধতি ব্যবহার করার ব্যাপারেও আমি স্বস্তিবোধ করি।
এপ্রিল বলেন এর মধ্যেও যদি তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন, তাহলে এই পদ্ধতিকে দোষ দেবেন না। কারণ সবকিছুর মধ্যেই ঝুঁকি আছে। আপনার যদি সন্দেহ থাকে, এবং আপনি এখন মা হতে না চান, তাহলে এই পদ্ধতির একটা ব্যাক-আপ রাখবেন। মনে রাখবেন কনডমও কিন্তু ১০০ ভাগ কার্যকরী নয়।
সবার জন্য উপযোগী নয়
ব্রিটেনে জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা এনএইচএসের মতে প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণকারী একজন নারীকে তার মাসিকের চক্রের সময় কী ধরনের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যায় সেগুলো বুঝতে হবে।
এর মধ্যে রয়েছে এই চক্র কতদিন ধরে চলে সেটা দেখা, প্রতিদিনের তাপমাত্রা পরিমাপ করা এবং উর্বর সময়ে জরায়ুর মুখ থেকে পানির মতো যে পদার্থ বের হয়ে আসে তাতে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে সেসব বিষয়ের ওপর নজর রাখা।
এনএইচএস বলছে, এই বিষয়গুলোকে যদি নিয়মিত ও সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়, তাহলে এই পদ্ধতি ৯৯ শতাংশ কার্যকরী হতে পারে।
তবে এনএইচএসে যৌন স্বাস্থ্য বিষয়ক একজন চিকিৎসক এনাবেল সোয়েমিমো বলছেন, এই পদ্ধতি সবার জন্য উপযোগী নয়।
তিনি বলেন, আপনার লাইফ-স্টাইল যদি স্থিতিশীল না হয়, যদি সবসময় আপনার হাতের কাছে ক্যালেন্ডার, থার্মোমিটার না থাকে, আপনার ঘুমের ধরন যদি অনিয়মিত হয়, তাহলে এই পদ্ধতির ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। যেসব নারীর মাসিক নিয়মিত নয়, যাদের পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম আছে অথবা যেসব নারী মাত্রই সন্তান জন্ম দিয়েছেন, তাদেরকে এই পদ্ধতি ব্যবহারের জন্য সুপারিশ করা হয় না।