১৪৯
নানা কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের যুক্তরাষ্ট্র সফর ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার পরেও সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে ‘গোস্যা’ করে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘২০ ঘন্টা জার্নি করে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার দরকার নেই।’ ধারণা করা হয়েছিলো তিনি হয়তো আর যুক্তরাষ্ট্র আসবেন না। কিন্তু তিনি সবাইকে অবাক করে ২০ ঘন্টা জার্নি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এসেছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে এত বকাঝকা, অভিমানী কথা-বার্তার পরেও এই দেশে আসা, অল্প কিছুদিন পরেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি’র আন্দোলন, সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে নানা আলোচনার ডালপালা সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানার এবং প্রশ্ন করার অনেক সুযোগ ছিলো। কিন্তু আওয়ামী সমর্থক কোনো সাংবাদিকই সে সব প্রশ্ন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারী নূরে এলাহী মিনার এর প্রেসক্রিপশনে ও নির্দেশনায় বিশেষ কয়েকজন সাংবাদিককে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হয়। ওইসব সাংবাদিকদের বেশির ভাগই সক্রিয় হন প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে এলে। কোনো সিনিয়র প্রবাসী সাংবাদিককে সেখানে দেখা যায়নি। সম্ভবত সমালোচনা এড়ানোর জন্যই তারা সেই তথাকথিত ‘মিট দ্যা প্রেস’ এ অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকেন। কারণ সেখানে হাজির হলে বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী আগে থেকে বলে দেয়া প্রশ্নটিই করার সুযোগ হয়। তার বেশি কিছু বললে বা বলার চেষ্টা করলে তাকে বের করে দেয়া হয়। বাংলাদেশের বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, গনতন্ত্র, নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বা জয়ের বর্তমান অবস্থান কিংবা যুক্তরাষ্ট্রে না আসার ঘোষণা দেয়ার পরেও যুক্তরাষ্ট্রে আসা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারেন এমন সাংবাদিকদের বরাবরের মতোই কালো তালিকায় রাখা হয়েছিলো। মূলত প্রধানমন্ত্রীকে কেউ কোনো প্রশ্নই করেননি। সবাই পরামর্শ দিয়েছেন। প্রশ্নগুলো আরও দুদিন আগেই প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস নূরে এলাহী মিনা কোন সাংবাদিক কি প্রশ্ন করবেন তা তৈরি করে তাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। তখন তাদের জানা ছিলো না যে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালেই যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে স্যাংকশনের ঘোষণা আসবে। স্যাংকশনের ঘোষণা আসার কারণে প্রশ্নের সাথে উত্তর মিলেনি বা উত্তরের সাথে প্রশ্ন মেলেনি। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন এবং মিডিয়া টিম হ্যান্ডলারদের পক্ষ থেকে বারবার জানানো হয়েছে,
যারা প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন তাদের নাম ও যে প্রশ্ন করা হয়েছিলো তা হুবহু তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন ১ : আমি শাখাওয়াত সেলিম, সম্পাদক ইউএসএ নিউজ অনলাইন। ইন্ডিয়াতে যে সম্মেলন হয়েছে সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আপনার যে সেলফি এটা সারাবিশ্বে এখন খুবই ভাইরাল। আসলে সেখানে প্রেসিডেন্টের সাথে কি কথা হয়েছিলো? সেটা যদি একটু জানান এবং এখানে বাইডেনের সাথে যে নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন সেখানে কি কথা হয়েছে যদি একটু জানান। প্রশ্ন ২ : আমার নাম শামীম আহম্মেদ। আমি এখানকার টিভিএন ২৪ টেলিভিশনের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে.. তো খুব ভাল্লাগছে। ২০২৬ সাল আর মাত্র দু’বছর। দুবছরের কিছু বেশি সময়। বাংলাদেশ, আপনি যখন ২০০৯ সালে ক্ষমতায় বসেছিলেন তখন থেকে মাত্র ১৭ বছরের ব্যবধানে একটি স্বল্পোন্নত দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ সেখান থেকে উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছে। ‘ইটস এ্যা ম্যাজিক।’ আমরা শুনেছি আপনি নাকি ঘুমান না। আপনি যতটুকু ঘুমান এটা হিসাবে ধরা যায় না। আসলে এই যে আপনার ফিটনেস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই যে আপনার ফিটনেস এত লং সময় ধরে আপনি কাজ করেন, এই ফিটনেসের রহস্য কি সেটা জানতে চাই। আর দুই নম্বর প্রশ্ন হলো এই আপনার যে অর্জন সেই অর্জনের পিছে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সেই মানুষ এখনও আছে। যারা দূর্নীতির আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে। তো পরবর্তী নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসে এই নরকের কীটগুলোকে বের করার জন্য আপনি কি ব্যবস্থা নিবেন? প্রশ্ন ৩: লাভলু আনসার, বাংলাদেশ প্রতিদিন, উত্তর আমেরিকার নির্বাহী সম্পাদক। আপনার বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে মানবাধিকারের ইস্যু থেকে যাতে উন্নয়নশীল বিশ্বের উপর রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কেউ ব্যবহার না করে ’ এতে সচেতন প্রবাসী সবাই আমরা উপলদ্ধি করি। আপনি যথার্থই বলেছেন, যেহেতু আপনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা। আজ সকালেই যেমনটি দেখলাম, স্টেট ডিপার্টমেন্ট আরেকটা নির্দেশ জারি করেছে, ‘যারা নির্বাচনের বিরোধীতা করবে, নির্বাচন নিয়ে হোলী খেলা খেলবে, সন্ত্রাস করবে, তাদেরকে নাকি তারা চিহ্নিত করেছে কয়েকজনকে, তাদেরকে ভিসা দিবে না এবং তাদের পরিবারের যারা আত্মীয়-স্বজন আছে সন্তান আছে তাদেরকেও নিষিদ্ধ করবে যুক্তরাষ্ট্রে। তো এই বিষয়টাকে প্রতিহত করার জন্য তারা একবাক্যে বলেছে আপনার যে অঙ্গিকার সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেয়ার এ ব্যাপারে তাদের কোনো দ্বিমত নাই। সম্ভবত তারা সেই আলোকেই এই সব এ্যাকশনে যাচ্ছে। তারপরেও আজকে যাদেরকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশই আমরা শুনতে পাচ্ছি যে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বা শীর্ষস্থানীয় আমলাদেরকে তালিকাভূক্ত করেছে। এই বিষয়টাকে ওভারকাম করার জন্য আপনার কি পদক্ষেপ হবে যেহেতু সামনে নির্বাচন। প্রবাসীরাও চায় সুন্দর একটা নির্বাচন হোক আপনার অঙ্গিকার অনুযায়ী। একটা নিরপেক্ষ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, নির্বাচন আসুক। প্রশ্ন ৪: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি আমাদেরকে আরও একবার সময় দিয়েছেন। আমার নাম শামীম আল আমীন। ঢাকার ৭১ টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি। আমরা রাজনীতি নিয়ে কথা শুনছিলাম। আপনি এর বাইরে যেহেতু ইউএনএ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। যেগুলো আমাদের জন্য এবং বিশ্ববাসীর জন্য খুবই সম্মানজনক। যেমন কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে আপনার প্রস্তাব প্রশংসিত হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন আপনি জাতিসংঘেও দেখতে চান। কোনদিন যদি জাতিসংঘের মহাসচিব একজন নারী হন সেই কৃতিত্ব কিন্তু আপনিই পাবেন। এই জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। প্রশ্নটা হচ্ছে রোহিঙ্গা নিয়ে। কারণ করোনা ইস্যু এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সবার দৃষ্টি সরে গেছে। আবার কি সেই জায়গায় ফিরে যেতে পারবো? অনেকদিন হয়ে গেলো। প্রশ্ন ৫: আমি তাহিয়াত রুবাইয়াত অপলা, টিবিএন ২৪। প্রথমেই আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি নিউ ইয়র্কে। আমরা আপনার জীবনের অনেক লড়াই দেখেছি। সংগ্রাম যেমন দেখছি, তেমনি আপনার গঠনমূলক অনেক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হতেও দেখেছি। আমি একটু ভবিষ্যত সম্পর্কে একটা বিষয়ে জানতে চাইবো। আমরা সম্প্রতি দেখছি যে আপনি যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, আমরা যদি বলি জি-২০ সম্মেলনে আপনি যখন নৈশভোজে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে আপনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ আপনার পাশে ছিলেন। পরবর্তীতে আমরা আরও অনেক অংশগ্রহণে আপনাকে দেখেছি তার সাথে। আমরা যদি ভবিষ্যতের দিকে একটু তাকাতে চাই আপনি যেহেতু নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশে একটি চমৎকার রোল মডেল হতে পারেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। সেই ক্ষেত্রে কি বাংলাদেশের মানুষ ভবিষ্যত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সায়মা ওয়াজেদকে পেতে পারে কিনা? কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? প্রশ্ন ৬ : মল্লিকা খান মুনা, মাই টিভি ইউএসএ। দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু একটি চক্র নানা অপপ্রচার ও গুজব ছড়াচ্ছে। ছড়িয়ে প্রবাসীদের বিভ্রান্ত করছে। বৈধ উপায়ে রেমিটেন্স পাঠাতেও নিরুৎসাহিত করছে। দেশের বিরুদ্ধে এই সব ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আপনার পরিকল্পনা আছে কিনা? প্রশ্ন ৭: সঞ্জীবন কুমার, সাপ্তাহিক আজকাল। আপনি জানেন নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের রাজধানী। সেখানে শত শত বাঙ্গালীরা ব্যবসা করেন। অনেকেরই আশা আপনাকে তারা এক নজর দেখতে চায়। সেই আমন্ত্রণ জানিয়ে আপনাকে প্রশ্ন, আপনি জানেন যে জলবায়ুর প্রতিক্রিয়ার জন্য উন্নয়নশীন দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনি প্রথম থেকেই ভূমিকা রেখে আসছেন। বাংলাদেশের ক্ষতিপুরণ চাওয়ার ব্যাপারে আপনার ভূমিকা আছে কি না? প্রশ্ন ৭ : আলমগীর হোসেন, বাংলা টিভির বিশেষ প্রতিনিধি। আপনার কাছে একটা ছোট্ট প্রশ্ন, আমরা প্রবাসীরা কিভাবে সামনে ইলেকশনে ভোট দিতে পারবো সে বিষয়ে আপনার সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা? সেই সাথে আপনিতো অনেক উন্নয়ন করেছেন, এবার যদি আপনারা সরকার গঠন করতে পারেন, তাহলে আপনার কাছে একটা দাবি উত্তরবঙ্গের আরিচা থেকে নগরবাড়ী পর্যন্ত একটি সেতু দিবেন এটা আমাদের দাবি। আপনি বললেই হবে ইনশআল্লাহ। এসব কথার জবাবে প্রধানমন্ত্রীর তেমন কিছুই বলার ছিলো না। তবে খালেদা জিয়া, জিয়াউর রহমানের অতীত সমালোচনা করেন কথার ফাঁকে ফাঁকে। লাবলু আনসারের প্রশ্নের জবাবে অবশ্য তিনি অপ্রাসঙ্গিকভাবে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, ‘ আমার ছেলে তো এখানেই পড়ালেখা করেছে, বিয়ে করেছে, বাচ্চা আছে যদি বের করে দেয় তাহলে আমাদের বাংলাদেশ আছে। ভয় পাই না।’ প্রধানমন্ত্রী স্যাংশনের সমালোচনা করতে গিয়ে বলেন, যে কারণে সাংকশন দেয়া হচ্ছে সেই নির্বাচন বানচালের চেষ্টা যদি দেশের বাইরে থেকে হয় তাহলে দেশের মানুষও তাদের বিরুদ্ধে স্যাংকশন দিয়ে দিবে। এক পর্যায়ে স্বগোর্তোক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া স্যাঙ্কশন নিয়ে বলেন, ‘ভালো হয়েছে, বিএনপি এখন আর জ্বালাও পোড়াও করতে পারবে না। আমেরিকার স্যাংকশন ঘোষণায় অন্তত মানুষের জীবনগুলো বাঁচবে। এটা খুবই ভালো হয়েছে। জামাত-বিএনপি আর মানুষ মারতে পারবে না।’